মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসবের বর্ণনা দাও।

অথবা, মুসলমান সম্প্রদায় কী কী ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে? বর্ণনা কর।
অথবা, মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে যা জান লিখ।
মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশের সমাজে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান (Institution)। এ দেশের মানুষ ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মীয় সভ্যতার বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এ দেশে পরস্পর সম্প্রতি ও সৌহার্দ্যবোধ বজায় রেখে স্ব-স্ব ধর্ম পালন করে আসছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসবসমূহ : বাংলাদেশে বিদ্যমান সম্প্রদায়ের লোকজন যে | সকল ধর্মীয় উৎসব পালন করে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ঈদুল ফিতর (Idul Fitur) : ঈদ শব্দের অর্থ খুশি। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই খুশির দিন আছে। মুসলমানদের জন্য এমন একটি খুশির দিন হলো ঈদুল ফিতরের দিন। একটি মাস রমজানের রোজাব্রত পালন করার পরই আসে ঈদুল ফিতর। এ ঈদে ‘ফেতরা’ (রমজান মাসের শেষে দীন দরিদ্রদিগকে দেওয়া নির্ধারিত পরিমাণ গম, চাউল বা টাকা পয়সা) দেওয়া হয় বলে এটাকে ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত করা হয়। রোজার পরিশুদ্ধতা অর্জনের জন্য ধনীরা গরিবকে যে অর্থ প্রদান করে থাকে তাকেই ফিতরা বলা হয়। সারাদেশে ঈদুল ফিতর পূর্ণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদার সাথে প্রতিপালন করা হয় ।
২. ঈদুল আজহা (Idul Azha) : ঈদুল আজহাও মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রতি বছর জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে এ উৎসব পালিত হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বপ্নে তাঁর প্রিয়বস্তু কোরবানির জন্য আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হন। তাই তিনি আল্লাহর সন্তুটি বিধানে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ) কে কোরবানি করতে মনস্থ করেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইব্রাহীমের প্রভু ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে হালাল জন্তু কোরবানির আদেশ দেন। তখন থেকেই মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা জিলহজ মাসের ১০ B তারিখে ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ তারিখ আছরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত হালাল পশু দ্বারা কোরবানি করে থাকে। কোরবানিতে একদিকে আল্লাহর হুকুম পালনের মহড়া দেওয়া হয়, অপর দিকে আত্মীয়স্বজন ও সমাজের অভাবী লোকদের মধ্যে শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ কোরবানির গোশ্ট বিতরণ করা হয়। সর্বস্তরের মানুষের জন্যই দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শবেকদর (Shabekadar) : ‘শবেকদর’ শব্দের অর্থ সম্মানের রাত্রি। রমজান মাসের ২৭ রজনীই হচ্ছে ৪ শবেকদর। মুসলমানদের জন্য এ রাত্রির বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এ রাত্রিতেই মানুষের একমাত্র জীবন বিধান আল-কুরআন নাজিল হতে শুরু করে। এ রাতকে সংক্ষেপে কুরআন নাজিলের রাত বলা হয়। কদরের রাত খুবই মহিমান্বিত। আল্লাহপাক এ রাতে তার বান্দার সব গোনাহ্ ক্ষমা করে দেন। তাই বান্দাহ তার দরবারে আত্মনিবেদন করে থাকে রাতে। এ রাতে ফেরেশতার শিরোমণি জিবরাইল (আ) এর সাথে অগণিত ফেরেশতা দুনিয়ার বুকে অবতীর্ণ হয়। এ রাতে এমন একটি সময় আছে যখন মানুষের আরজি আল্লাহ পাকের দরবারে গৃহীত হয়ে থাকে।
৪. শবেবরাত (Shabebarat) : ‘শবেবরাত’ শব্দের অর্থ ভাগ্য রজনী। কেননা, এ রাতে মানুষের ভাগ্য রচনা করা হয়। শবেবরাত মুসলিম দুনিয়ায় একটি বিশেষ পরিচিত অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান। আরবি শাবান মাসের ১৪ই তারিখের রাতকেই শবেবরাত বলা হয়ে থাকে। এ রাতেই আল্লাহ পাক নিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং সব মানুষের দুঃখ বেদনার কথা শ্রবণ করেন। এ রজনীতে আল্লাহ পাক তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। শবেবরাত মুসলমানদের জন্য একটা বিশেষ ইবাদতের রাত।
৫. মিলাদুন নবী (Miladun Nabi) : ‘মিলাদুন নবী’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নবীর জন্ম। ১২ই রবিউল আউয়াল নবী করিম (স) এর জন্ম হয়েছিল। তাঁর জন্মদিনকে নিয়ে প্ রতি বছর ঈদে মিলাদুন নবী পালিত হয়ে থাকে। এটিও একটি খুশির দিন। ধর্মানুরাগী মানুষেরা নবী (স) এর জন্ম দিনে রোজাব্রত পালন করে থাকে। মসজিদে মসজিদে মিলাদ মাহফিল পাঠ করা হয়। আমাদের দেশে দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। মসজিদে ইমাম সাহেবদের পরিচালনায় হামদ, নাত ও কেরাত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। এদিনের স্মরণে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিভাবে একটি অধঃপতিত জাতি মহানবী (স) এর আগমনে উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল তারই বিভিন্ন দিক আলোচিত হয় এ দিনে।
৬. মুহররম (Muharram) : মুহররম মুসলমানদের জন্য একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মুহররম মাসের ১০ তারিখ মুসলমানদের জন্য একটা হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণা ঘটে। এদিনে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর পৌত্র ইমাম হোসেন (রা) কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের হাতে নিহত হন। ইমাম হোসেন (রা) সত্যকে সমুন্নত রাখার জন্য এবং মিথ্যার সামনে মাথানত না করার জন্যই পরিবার পরিজন নিয়ে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ইসলামের ইতিহাসে এর চেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা নেই বললেই চলে। কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে প্রতি বছর মুসলমানগণ এ দিনকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। এদিনকে আশুরার দিনও বলা হয়। ‘আশুরা’ শব্দের অর্থ দশ। মহররম মাসের দশ তারিখে এ ঘটনা ঘটেছিল বলেই এটাকে এরূপ বলা হয়ে থাকে। কারবালার স্মরণে বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা গুরুত্ব সহকারে দিবসটি পালন করে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমানরা বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠী। মুসলমানরা বছরে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তন্মধ্যে ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেকদর, শবেবরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী অন্যতম। এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে মুসলমান সম্প্রদায় পালন করে থাকে।