ধর্ম সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনাপূর্বক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, কার্ল মার্কসের ধর্মতত্ত্বটি আলোচনা কর।
অথবা, ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা কর।
অথবা, কার্ল মার্কসের ধর্মতত্ত্বটি সমালোচনাসহ বর্ণনা কর।
অথবা, ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসের মতবাদ সমালোচনাসহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ঊনবিংশ শতাব্দিতে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীর মত মার্কস অনুরূপ পদ্ধতিতে ধর্মের উৎপত্তি ও চরিত্র ব্যাখ্যা করতে অগ্রসর হন। মার্কসের ধারণা ধর্ম কতকগুলো অধিকতর মৌলিক উপাদান থেকে উদ্ভূত একটি বিষয়। এটি নিছক একটি আনুষঙ্গিক লক্ষণ। এর কোনো কার্যকারণ তাৎপর্য নেই। মার্কসের ধারণা প্রাকৃতিক প্রপঞ্চসমূহ দ্বারা সৃষ্ট ভয় ও উৎকণ্ঠা থেকেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে এবং এটি হচ্ছে এক ধরনের মোহ (illusion)। মার্কস ধর্মকে ধুরন্ধর ও সুবিধাবাদীদের উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি বলে মনে করেন। মানব সমাজের বিকাশের বিভিন্ন স্তরে শোষিতের সংগ্রাম ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি : ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. ধর্ম, মানুষ ও শ্রেণি চেতনা : Marx এর মতে, ধর্মবোধের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। তিনি ধর্মকে সমাজের ‘Super structure’ এর অংশ হিসেবে মনে করেন। তাই তিনি বলেছেন, “Religion is one of the form of social consciousness, one of the elements of super structure in class society.” মার্কসের ধারণা মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি। ধর্মীয় চেতনা মিথ্যা এবং অলীক। সুতরাং, “We should not fear the gods, we ourselves have created.” মার্কস দেখিয়েছেন যে, ধর্ম শোষিত ও নিষ্পেষিত মানুষকে নিস্তেজ ও হীনবল করে দেয়। সম্পত্তিবান শ্রেণির অমানবিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিকারের স্বার্থে সম্পত্তিহীন শ্রেণির সুদৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাস থাকা অত্যাবশ্যক। ধর্মবিশ্বাস বিত্তহীন মানবগোষ্ঠীর এ মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে অবদমিত করে। মার্কসের মতানুসারে ধর্ম হলো স্বার্থান্বেষী শোষক শ্রেণির হাতে ন্যস্ত একটি বিশেষ হাতিয়ার। এ হাতিয়ারের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ মানুষকে আফিমের ন্যায় মোহাচ্ছন্ন ও অবশ করে রাখা হয়। এজন্য তিনি ধর্মকে ‘opium of the people’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ধর্ম সমাজের দরিদ্র ও দুর্বল মানবগোষ্ঠীকে ভয়ভীতি সন্ত্রস্ত করে রাখে এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সার্বভৌম কর্তৃত্ব কল্পনা করতে বাধ্য করে। মার্কসের মতানুসারে ধর্ম হলো একটি অলীক সূর্যস্বরূপ। এ সূর্য তত দিন পর্যন্ত মানুষের চারদিকে পরিক্রমা করে যতদিন তার নিজের চারদিকে মানুষ আবর্তিত না হয়। তাঁর নিজের কথায় “Religion is the only illusory sun which revolves round man as long as he does revolve round himself.”
২. দ্বন্দ্ববাদী ও জড়বাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি : মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস হলো অলীক, অবান্তর ও অযৌক্তিক। মার্কসবাদ অনুসারে একমাত্র জড়ই (Matter) হলো চরম সত্তা। দৈহিক, মানসিক, সামাজিক সব ঘটনার রয়েছে জড়সত্ত্বা, এদের পিছনে কোনো অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব নেই। মানুষ God বা Supernatural power বা সর্বশক্তিমান সত্তার কল্পনা করে ধর্মীয় পরিবেশ তৈরি করে। প্রত্যেক ধর্মই মনে করে যে, ধর্মীয় অনুমানগুলো ঈশ্বর প্রদত্ত ব্যবস্থা। ফলে তারা মনে করে God তাদেরকে সব বিষয়ে শাসন করে এবং ক্রমে তাদের মনে বাস্তবতা বিবর্জিত একটি উল্টো ধারণা বদ্ধমূল হয়। কিন্তু মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই। তিনি সমাজের যাবতীয় বিষয়কে জড় উপাদান বা অর্থনৈতিক বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
৩. ধর্ম হলো বিপরীত জগৎ চেতনা : মার্কসের মতে, ধর্ম সত্যকে বিকৃত করে এবং মানুষের মনে ভ্রান্ত মূল্যেবোধের সৃষ্টি করে। মার্কসবাদ অনুসারে নিয়তি, বিবেক, ক্ষমা, ধৈর্য, দয়াদাক্ষিণ্য প্রভৃতি হলো মানুষের দুর্বল ও হীন বৃত্ত ি। ধর্ম এ হীন বৃত্তিগুলোকেই মহান রূপে প্রতিপন্ন করে। এ বিশ্ব সংসার সম্পর্কে ধর্ম মানুষের মনে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে। ধর্মীয় চেতনা হলো সত্য বা বৈজ্ঞানিক চেতনার বিপরীত বা বিরুদ্ধ চেতনা। এ জগৎ সংসার সম্পর্কে সঠিক ধারণার পরিবর্তে ধর্মীয় চেতনা ও বিধিবিধান বিপরীত চেতনার (reversed world consciousness) সৃষ্টি করে।
৪. ধর্ম সামাজিক অগ্রগতির পরিপন্থি : Marx এর মতে, আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে বিশ্বাসীরা মানুষকে কর্মবিমুখ করে তোলে। ধর্মীয় বিধি নিষেধ মানুষের চিন্তাচেতনা, উৎপাদন কর্মে অন্তরায় সৃষ্টি করে, যা সামাজিক অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে।
৫. ধর্ম অদৃষ্টবাদের জন্ম দেয় : শ্রমজীবী জনসাধারণ যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ও যাতনাকে নিজেদের নিয়তি বা অদৃষ্ট হিসেবে মেনে নেয়। দুঃখ দারিদ্র্যের যথার্থ কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিকারের প্রচেষ্টা থেকে তারা বিরত থাকে। এ জগতের সব অর্থনৈতিক অত্যাচার ও শাসন শোষণ মুখ বুজে সহ্য করে গেলে মৃত্যুর পর পরপারে তাদের জন্য স্বর্গরাজ্য নির্দিষ্ট থাকবে, ধর্ম মেহনতী মানুষের কাছে এ সান্ত্বনার বাণী বহন করে আনে।
৬. সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম অবলুপ্ত হবে : মার্কসবাদীদের মতানুসারে, আধুনিককালের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ধর্মবোধ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমাজের মেহনতী মানুষের উপর শাসন শোষণ বজায় রাখতে এবং স্বার্থান্বেষী পুঁজিপতি শ্রেণির কায়েমী স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং, শ্রেণি শোষণের অবসান ঘটলে ধর্মও অবলুপ্ত হবে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায় থাকবে না। শ্রমজীবী সম্প্রদায়
সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যথার্থ সুখস্বাচ্ছন্দ্যের স্বাদ পাবে। এ অবস্থায় তারা ধর্মের আধ্যাত্মিক মোহে আচ্ছন্নভাব কাটিয়ে উঠবে। ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা :
১. Karl Marx এর ধর্মের তত্ত্ব মূলত ডারউইনের জড়বাদী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। সেহেতু জড়বাদ এখনও অভ্রান্ত মতবাদ নয়, সেহেতু তার ধর্মীয় মতবাদ ভ্রান্ত হতে পারে নিঃসন্দেহে।

  1. পুঁজিবাদী মার্কসবাদীদের মতানুসারে, ভয় থেকে ভগবানের ও ধর্মের উদ্ভব হয়েছে। বলা হয় যে, সমাজব্যবস্থার উদ্ভব এবং শাসক ও শোষিত শ্রেণির মধ্যে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে ধর্মবোধের সৃষ্টি হয়েছে। মার্কসবাদের এ যুক্তি যথার্থ নয়। কারণ ধর্মের ইতিহাস হলো মানবজাতির ইতিহাসের
    সমসাময়িক।
    ৩. মার্কসবাদ অনুসারে ধর্মীয় চেতনার অস্তিত্ব সমাজের শুধুমাত্র শোষিত, সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে দেখা যায়, মার্কসবাদের এ বক্তব্য মোটেই যথার্থ নয়। সম্পত্তিবান, সম্পত্তিহীন নির্বিশেষে সমাজের অধিকাংশ মানুষ
    নিজ বিশ্বাস ও অনুভূতি অনুসারে ধর্মাচরণ করে।
    ৪. মার্কসের দর্শনে ধর্মকে শাসন শোষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যথার্থ ধর্মের মধ্যে শোষণ পীড়নের কোনো উপাদান থাকে না। প্রকৃত ধর্ম হলো সদযুগের ধারক ও বাহক। D. E. Trueblood তাঁর ‘Philosophy of Religion’ গ্রন্থে তাই মন্তব্য করেন, “Marxism sees neither the essential greatness or the essential misery of man.”
    ৬. মার্কসবাদে ধর্মকে আফিম হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ধর্ম সম্পর্কিত এ মার্কসীয় ব্যাখ্যা বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন
    হয়েছে। প্রকৃত ধর্মবোধ মানুষের যাবতীয় দুর্বলতা দূর করে। মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা ও আশার সঞ্চার করে।
    ৭. মার্কসীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ধনতান্ত্রিক অবস্থার পরবর্তী স্তর সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটবে এবং তখন ধর্মের অবসান ঘটবে। মার্কসের এ ধারণা ঠিক নয়। উপর্যুক্ত এসব উক্তির অসারতা আজ সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক নীতির পতন ও তার তাত্ত্বিক উপযোগিতা হারানোর সাথে ধর্মের বাস্তবতা ফুটে উঠে। মার্কসবাদীদের মতানুসারে ধর্ম ও বিজ্ঞান হলো পরস্পরবিরোধী। প্রকৃতপক্ষে, ধর্ম ও বিজ্ঞান হলো জ্ঞান জগতের দু’টি অংশবিশেষ। তাদের মধ্যে মৌলিক কোনো বিরোধ নেই।
    উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কসীয় তত্ত্ব জড়বাদী ও দ্বান্দ্বিক দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। মার্কসবাদীদের অভিমত অনুসারে মানবসমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির একমাত্র উপায় হলো অর্থনৈতিক অবস্থার সামগ্রিক অগ্রগতি। কিন্তু এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। মানবসমাজের সামগ্রিক কল্যাণ বা চরম বিকাশ সাধনের জন্য সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন একান্তভাবে অপরিহার্য।