বিচ্যুতির সংজ্ঞা দাও। বিচ্যুতি ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

অথবা, বিচ্যুতির সংজ্ঞা লিখ। বিচ্যুতি ও অপরাধের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, বিচ্যুতি কী? অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে বৈসাদৃশ্যসমূহ তুলে ধর।
অথবা, বিচ্যুতি কাকে বলে? অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা :
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে স্ব-স্ব সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধ এবং আইন মেনে চলতে হয়। আবার মানুষ তার স্বীয় অস্তিত্বের বাইরে অতি প্রাকৃত একটি শক্তির অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে যার ভিত্তি হলো কতকগুলো Rule, অনুশাসন ও বিধিনিষেধ মেনে নেওয়া। সে ধর্মীয় বিধিনিষেধ পরিপন্থী কাজই হলো পাপ, যা থেকে বিচ্যুতি ও অপরাধকে পার্থক্য করা যায় না। মূলত সমাজে প্রচলিত যাবতীয় সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিভঙ্গ করাই হলো বিচ্যুতি ও অপরাধ।
বিচ্যুতি (Deviance) : ইংরেজি Deviance এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘বিচ্যুতি’। বিচ্যুতি বলতে এমন এক ধরনের আচরণকে নির্দেশ করে যা স্বাভাবিক এবং কাঙ্ক্ষিত আচরণের পরিপন্থী। সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আর এ পরিবর্তনশীল সমাজের বিচ্যুতিমূলক আচরণের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটে। সাধারণভাবে বিচ্যুতিমূলক আচরণ বলতে কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও সংস্কৃতি বিরোধী কার্যক্রমকে বুঝায়।
সাধারণ অর্থে : আমরা অনৈতিক, অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত আচরণকে বিচ্যুতি বললেও সমাজতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতে Deviance “Any behaviour that violates social expectations.” (Sociology by Federico) সহজ কথায়, মানুষের যে আচরণ সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয় এবং যে আচরণ সমাজে প্রচলিত যাবতীয়, প্রত্যাশা যেমন- আদর্শ, মূল্যবোধ, আচরণ, নিয়মকানুন ইত্যাদির পরিপন্থী সে আচরণই হলো Deviant Behaviour বা বিচ্যুতিমূলক আচরণ। আর এ জাতীয় আচরণকারী হলো Deviant. Wishleiminan
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে বিচ্যুতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো : Deviance এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Emile Durkheim বলেছেন, “সমাজ কাঠামোর বৃহৎ অংশ যখন তাদের ন্যায়পরায়ণতা ও সাধুতা হারিয়ে ফেলে মূল্যবোধহীন রাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয় তখন সেই পরিস্থিতি
হলো Deviance বা বিচ্যুতিকরণ।” POT Stewart and Glynn , “Social Deviance is a variation form the norms of society that represents some form of undesirable difference.” (Introduction to Sociology, P-155) Ross, “Deviant behaviour is that behaviour which does not confirm to social expectation.”
সমাজবিজ্ঞানী R. K Merton এর মতে, “Deviant behaviour is a behaviour violates institutionalized expectations, which are shared and recognized as legitimite within a social system.”
সমাজবিজ্ঞানী Ogburn and Nimkoff এর সংজ্ঞানুসারে-
i. Social Deviance অর্থ গোষ্ঠীর রীতিনীতি মেনে না চলা।
ii. সমাজের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন রকম রীতিনীতির জন্য সমাজে Sub Culture গড়ে উঠে এবং এসব গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠী উগ্রপন্থি হয়ে Deliquent এ পরিণত হয়।
অন্যদিকে বিচ্যুতির সংজ্ঞায়, Schaefer and Lamm বলেছেন, “Deviance is the behaviour that violates the stranders of conduct or expectation of a group or society. (Sociology- P-115) David Popenoe 4, “Deviance is a behaviour that violates the social norms of a group or society.” (Sociology) Robertson 4, “Deviance is a behaviour or characteristics that violate significant social norms and expectations are negatively valued by a large number of people in consequence.” (Sociology-1980) Ross, “Deviant behaviour is that behaviour which does not confirm to social expectation.”
P. B. Horton এবং C.L Hurt তাঁদের ‘Sociology’ গ্রন্থে বলেছেন, “The term social deviance is given to any failure to confirm to the customary norms of the society.”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, মানুষের যে সকল আচরণ সমাজকর্তৃক স্বীকৃত নয় এবং আদর্শ, মূল্যবোধ পরিপন্থী তাকে বিচ্যুতিমূলক আচরণ বলে। সহজ কথায়, যা স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান করে তাই বিচ্যুতিমূলক আচরণ। বিচ্যুতি ও অপরাধের মধ্যে পার্থক্য (Difference between Deviance and Crime) : সমাজ বা রাষ্ট্রের আইন ভঙ্গমূলক কাজই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। অপরাধমূলক কাজের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। অন্যদিকে, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থী কাজগুলো বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচিত এবং এ কাজের জন্য সমাজস্থ মানুষ বিচ্যুতি আচরণকারীকে নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে। নিম্নে বিচ্যুতি ও অপরাধের মধ্যকার পার্থক্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. বিচ্যুতি বা Deviance ও অপরাধ বা C rime অনেকটা একই রকম মনে হলেও সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীদের বর্ণনা মতে এদের সংজ্ঞাগত পার্থক্য স্পষ্ট। বিচ্যুতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে R.T. Schaefer and R.P. Lamm , “Deviance is behaviour that violates the standards of conduct or expectations of a group of society.”
অপরদিকে অপরাধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে R.T. Schaefer and R.P. Lamm বলেছেন, “Crime is a violation fo criminal law for which formal penalties are applied by some governmental authority.”
৮.আইন ভঙ্গমূলক কাজই অপরাধ। কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজ বা আচরণ প্রদর্শন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হয়। কিন্তু সমাজে এমন অনেক কাজ ও আচরণ লক্ষ্য করা যায় যা
আইনের নিষিদ্ধ না হলেও সেসব সমাজের পরিপন্থী যাকে বিচ্যুতি বলা যায় । আইন বিরোধী বা আইন ভঙ্গমূলক কাজ অপরাধের আওতায় পড়ে। অন্যদিকে, সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী কাজ বা আচরণ বিচ্যুতির পর্যায়ে পড়ে। সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণের কোনো কোনো দিক কখনো কখনো অপরাধমূলক আচরণে পরিণত হতে পারে। যতই সামাজিক পরিবর্তন ঘটুক না কেন অপরাধ সবসময় বিচ্যুতিমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে। সব অপরাধই সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণ । কিন্তু সব সামাজিক বিচ্যুতিমূলক আচরণ অপরাধ নয় ।
কোনো কাজ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হলে অথবা আইন অনুসারে নির্ধারিত কর্তব্যে অবহেলা হলে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। অন্যদিকে, সমাজের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বিরোধী কাজই হলো বিচ্যুতি। অপরাধ সাধারণত আনুষ্ঠানিক কোনো বাহন বা সংস্থা দ্বারা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বিচ্যুতিমূলক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা অপরাধ থেকে অনেক সহজ।
অপরাধ সমাজের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। কিন্তু বিচ্যুতি আচরণে তুলনামূলক ক্ষতির পরিমাণ বেশি। অপরাধমূলক কাজ করতে সাধারণত জনগণ ভয় করে। অন্যদিকে, বিচ্যুতিমূলক আচরণ করতে তারা তেমন ভীত হয় না।
১০অপরাধমূলক কাজ ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে করে থাকে। কিন্তু বিচ্যুতি আচরণের কোনো পরিকল্পনার প্রয়োজন হয় না।
১১. অপরাধমূলক আচরণের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য শাস্তি নির্ধারিত নয়।
১২. Crime হলো Social Norms বিরুদ্ধে কোনো কাজ। অন্যদিকে, Deviance হলো Social Norms ও Folkways এর বিরুদ্ধে কোনো আচরণ ।
১৩. Crime হলো Deviance এর চূড়ান্ত পর্যায় এর Deviance হলো Crime এর পূর্বাবস্থা। Brown and Seleznick , “Crime is properly understood as part of the boarder phenomenon of deviance.”
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং অন্যান্য সমাজ আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে বিচ্যুতি ও অপরাধ পেয়েছে নতুন মাত্রা, ফলে অপরাধবিজ্ঞানের ধ্যানধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নীতিবোধ ঠিক থাকলেই অপরাধ ও বিচ্যুতিমূলক আচরণ হতে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব।