অপরাধ বিস্তারের পিছনে ভৌগোলিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, অপরাধ বিস্তারে ভৌগোলিক কারণ কতটুকু দায়ী? আলোচনা কর।
অথবা,অপরাধ বিস্তারের পিছনে ভৌগোলিক প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, অপরাধ বিস্তারের পিছনে ভৌগোলিক প্রভাব কতটুকু ভূমিকা পালন করে? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানব সৃষ্টির প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই পৃথিবীতে অপরাধ প্রবণতা বিস্তার লাভ করে। মানুষের স্বার্থপরতা, বর্বর মনমানসিকতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ মানুষকে অপরাধপ্রবণ হতে বাধ্য করে। অতি সম্প্রতি অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভৌগোলিক প্রভাবও মানুষকে অপরাধপ্রবণ হতে সহায়তা করে থাকে। কারণ মানবজীবনের উপর ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য। ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব এতই বেশি যে, জনসংখ্যা, পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্য ও পানীয়, অর্থনৈতিক জীবন, ব্যবসায় বাণিজ্য, মানবগোষ্ঠী, জন্মমৃত্যু, স্বাস্থ্য, ধর্ম, বিবাহ, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি, মানবসভ্যতার উত্থানপতন প্রভৃতির উপর এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না।
অপরাধ বিস্তারে ভৌগোলিক প্রভাব : নিম্নে অপরাধ বিস্তারের পিছনে বিভিন্ন ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জলবায়ুগত প্রভাব : কিছু কিছু গবেষক গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, যেসব অঞ্চল বা দেশে জলবায়ু অত্যধিক উষ্ণ, সেখানে অপরাধের পরিমাণ শীতপ্রধান দেশের তুলনায় বেশি। এ মতবাদের পিছনে যেসব যুক্তি দাঁড় করানো হয় তা হলো এই যে, উষ্ণ জলবায়ু মানুষকে সহসা উত্তেজিত করে তোলে। আর এ উত্তেজিত মানুষ যে কোনো মুহূর্তেই অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, এ ধরনের অনুকল্প পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব হয় নি। কারণ কতিপয় উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের মানুষ সহজেই উত্তেজিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে বটে, তথাপি উষ্ণপ্রধান অঞ্চল বা দেশের কোথাও কোথাও এ ধরনের উত্তেজনার প্রমাণ পাওয়া যায় নি, যা অপরাধের হারকে ব্যাপক মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে।
২. আবহাওয়াগত প্রভাব : অপরাধবিজ্ঞানী Dexter এবং Denver মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের New York শহরের উপর গবেষণা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, জলবায়ুর তারতম্যের জন্য অপরাধের হারে যেমন তারতম্য লক্ষ্য করা যায়, ঠিক তেমনি আবহাওয়ার তারতম্যও অপরাধের বিস্তারের উপর প্রভাব রাখে। নিম্নে Dexter এবং Denver এর অপরাধ বিস্তারে আবহাওয়াগত প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
ক. তাপমাত্রা বৃদ্ধি : কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে নিয়মিতভাবে অপরাধ হেতু গ্রেফতারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং তাপমাত্রা মানুষকে এমনভাবে আবেগপ্রবণ করে তোলে, যা তাকে অপরাধপ্রবণ করে তুলতে পারে।
খ. বাতাসের আর্দ্রতা : কোনো অঞ্চলে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গেলে সেখানে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে, আর্দ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের সংখ্যা হ্রাস পায়। অর্থাৎ আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে তা আবেগপূর্ণ উত্তেজনাকে স্তিমিত বা দমিয়ে দেয়।
গ. বাতাসের গতিবেগ : যেসব দিনে হালকা বা নমনীয়ভাবে বাতাস প্রবাহিত হয় অর্থাৎ যদি ঘণ্টায় ৬ থেকে ৮ মাইল বেগে বাতাস প্রবাহিত হয়, তাহলে কলহপ্রিয়তার হার বেড়ে যায়। অপরদিকে, বাতাসের গতি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে গ্রেফতারের হার হ্রাস পায়।
৩. ঋতুভেদে অপরাধের তারতম্য : অপরাধবিজ্ঞানী De Guerry, A. Wagner, Morselli, Krose, Dexter, G. Von Mayer সহ আরো অনেক গবেষক ইউরোপীয় এবং অ-ইউরোপীয় দেশে ঋতুভেদে আত্মহত্যার হার হ্রাসবৃদ্ধি পায় বলে উল্লেখ করেছেন। সমগ্র ইউরোপীয় দেশে গ্রীষ্মকালে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর এ আত্মহত্যার হার মে এবং জুন মাসে সবচেয়ে বেশি হয়; বসন্তকালে এ হার কিছুটা হ্রাস পায় এবং শরৎকালে এ হার আরো কিছুটা কমে আসে এবংশীতকালে সবচেয়ে কম আ ত্মহত্যা সংঘটিত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ঋতুভেদে অপরাধের মাত্রায় তারতম্য লক্ষ্য করা যায় ।
৪. কৃষিনির্ভর অঞ্চল : অনেক গবেষক তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, কৃষিনির্ভর দেশগুলোতে কোনো কোনো বিশেষ ঋতুতে বেশি পরিমাণে ফসল ঘরে উঠে। যেসব ঋতুতে ফসল তোলার কাজ সম্পন্ন হয়, তখন বিত্তবানদের ঘরে সম্পদ এবং টাকাপয়সার পরিমাণ বেড়ে যায়। এ সুযোগটি অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা গ্রহণ করে ফলে অপরাধের মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে, কোনো বিশেষ ঋতুতে যখন ফসল কম থাকার কারণে অভাব অনটন দেখা দেয়, তখনো মানুষ অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হতে পারে।
৫. আর্থিক অভাব অনটন এবং ব্যাপক জনসংখ্যা কবলিত অঞ্চল : কতিপয় গবেষক তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, প্রতিকূল ভৌগোলিক প্রভাবের ফলে যদি কোনো দেশ বা অঞ্চল আর্থিকভাবে অতিশয় দারিদ্র্য হয়ে পড়ে, তাহলে সেখানে অপরাধ বিস্তারের পিছনে ভৌগোলিক প্রভাবটি পরোক্ষভাবে কাজ করেছে। কেবল তাই নয়, ভৌগোলিক উপাদান যেহেতু অর্থনৈতিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে, সেহেতু বলা চলে যে, কোনো অঞ্চল বা দেশ প্রতিকূল ভৌগোলিক প্রভাবের ফলে স্বল্প সম্পদ দ্বারা সেদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা কতক পরিমাণ পূরণ করতে পারবে সে সম্পর্কেও একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়। আর এটা বলাবাহুল্য যে, কোনো অঞ্চলে জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কম হলে সেখানে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, বিভিন্ন ভৌগোলিক উপাদান অপরাধ বিস্তারের পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে একথা সত্যি যে, শুধু উচ্চ তাপমাত্রা, বাতাসের স্বল্প আর্দ্রতা কিংবা সূর্যের স্বল্প উজ্জ্বলতা অথবা মেঘাচ্ছন্ন দিন বলেই মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয় না, বরং বলা চলে যে, দারিদ্র্যের কারণে কিংবা বাড়ির
বাইরে গিয়ে সামাজিক মেলামেশায় অপরাধে লিপ্ত হয়। তবে একথা অবশ্য অস্বীকার করা যায় না যে, দারিদ্র্য ও ভৌগোলিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। সুতরাং ভৌগোলিক উপাদান দারিদ্র্য সৃষ্টি করতে পারে এবং দারিদ্র্য অপরাধের জন্ম দিতে পারে।