অথবা, মানবজীবনের উপর সংস্কৃতি কি প্রভাব বিস্তার করে আছে? আলোচনা কর।
অথবা, মানবজীবনের উপর সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মানবজীবনের উপর সংস্কৃতির প্রভাব কেমন? আলোচনা কর।
অথবা, মানবজীবনের উপর সংস্কৃতির প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা কর।
টিউিত্তরা৷ ভূমিকা : সংস্কৃতি একটি ব্যাপক প্রত্যয়। সভ্যতার বাহন হলো সংস্কৃতি। “Every man has his own culture.” অর্থাৎ, প্রত্যেক মানুষেরই সংস্কৃতি আছে। একজনের সংস্কৃতি অন্যের চেয়ে আলাদা। প্রত্যেক মানুষ ও গোষ্ঠীর নিজস্ব জীবনধারণের পদ্ধতি রয়েছে, এটিই তার সংস্কৃতি। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তুলতে সংস্কৃতির জুড়ি নেই। সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবন প্রণালি সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
মানবজীবনে সংস্কৃতির প্রভাব : মানবসমাজের সকল রূপ, সকল রীতিনীতি, প্রথা ও আচার ব্যবহারের উৎকর্ষকে সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। সামাজিক মানুষের ধারণা, ভাব, বিশ্বাস ও কলাকৌশলের অবিচ্ছেদ্য সামগ্রিকতাই সংস্কৃতি। সাধারণ অর্থে সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে মার্জিত রুচি ও এর অভ্যাসগত উৎকর্ষ । আবার সংস্কৃতি বলতে সহজ কথায় বুঝি ভাষা, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলা প্রভৃতির সূক্ষ্ম শিল্পচর্চা। সমাজবিজ্ঞানীগণ সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে চেয়েছেন। বর্তমানে ই.বি. টেলরের সংজ্ঞাই সবচেয়ে গুরুত্বারোপ করছে। ই.বি টেলরের মতে, “সংস্কৃতি হচ্ছে সেই জটিল একটি পূর্ণ ব্যবস্থা, যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সমাজবাসীর জ্ঞানবিজ্ঞান, ধর্ম, ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, শিল্প, আইন, আদালত, নীতিকথা, আচারব্যবহার, অভ্যাস, মূল্যবোধ প্রভৃতি যা তারা বংশানুক্রমে অর্জন করে।”
ই. বি. টেলরের সংজ্ঞানুযায়ী আমরা দেখি যে, সমাজবাসীর পূর্ণ জীবন প্রকাশই সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির প্রভাব ব্যক্তি মানুষের মধ্যে কখনও সচেতনভাবে, আবার কখনও অবচেতনভাবে কাজ করছে। পরিবেশের প্রভাবে মানুষের সংস্কৃতির রূপ কাঠামোর তারতম্য হয়ে থাকে। সমাজজীবনের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। এজন্য পরিবেশ অনুসারে প্রত্যেক সমাজের একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠে। পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনোভাব রক্ষা করার জন্য ব্যক্তিগতভাব এবং গোষ্ঠীবদ্ধভাবে মানুষের যে প্রচেষ্টা তা হতে সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে বলেই সংস্কৃতির প্রভেদ দৃষ্ট হয়। সুতরাং, পরিবেশের প্রভাবে সংস্কৃতি গড়ে উঠে। এজন্য বিভিন্ন
সমাজে বিভিন্ন রীতিনীতি, আচারব্যবহার ও জীবন প্রণালির তারতম্য বিদ্যমান। জীবতাত্ত্বিক বংশগতির মত সংস্কৃতি ক্রোমোজোম বা যৌনকোষের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয় না। পিতামাতার কাছ থেকেই হোক, আত্মীয় বা অনাত্মীয় লোকদের কাছ থেকেই হোক, যেসব কথা আমরা আশেপাশে শুনে থাকি, যেসব আচার আচরাণ দেখে থাকি তা আমাদের পরিবেশ দ্বারাই প্রভাবিত। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে
তুলনামূলকভাবে আলোচনা ও গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে দাবি করেন যে, মানুষ সম্পূর্ণরূপে তার সংস্কৃতির প্রভাবাধীন। বংশগতির প্রভাব কেবলমাত্র তার গায়ের রং এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণ প্রাণী ও উদ্ভিদের শুধু জীবতাত্ত্বিক বংশগতিই রয়েছে। কিন্তু মানুষ নিজ জীবনে আরও কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের সৃষ্টি করেছে, যাকে বলা যেতে পারে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। এ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গুণে মানুষ তার পূর্বপুরুষের কাজ থেকে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানের এবং সাহিত্য, কাব্য ও সংগীতের একটা বিরাট সম্ভার,
একটা ধর্মীয় ও নৈতিক ব্যবস্থা অর্জন করে থাকে। এমনকি সম্পূর্ণ নিরক্ষর ব্যক্তিও সংস্কৃতির প্রভাব এড়িয়ে যেতে পারে না। সংস্কৃতি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং উন্নতি, অবনতি, উত্থান বা পতন নিয়তই ঘটছে। এর প্রভাব সামাজিক মানুষের উপর বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। মানবজীবনে সাংস্কৃতিক প্রভাব এতই প্রগতিশীল যে, পৃথিবীতে যে বিচিত্র রকমের সংস্কৃতি রয়েছে আমরা ইচ্ছে
করলেই এদের যে কোনো একটা অর্জন করতে পারি। মানবজীবনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রভাব কখনও প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনও পরোক্ষভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অর্জিত সংস্কৃতি বহুদিন পরেও জীবতাত্ত্বিক বংশগতির আওতায় আসতে পারে না। অর্জিত গুণাগুণের উত্তরাধিকার একটি বৃহত্তর সমস্যা,
আর এটা তারই অংশবিশেষ। একদিকে যেমন পরিবেশগত প্রভাব, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক গতিশীলতা মানবজীবনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে তোলে, যার ফলে অর্জিত সংস্কৃতির প্রভাব জীবনব্যবস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পথ দেখায়। মার্কসীয় দৃষ্টিতে মানুষের বজ্রগত সাংস্কৃতিক উপাদানের সাথে জীবন ও জীবিকার সম্পর্কের ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, জীবিকা অর্জনের হাতিয়ার ও পদ্ধতির সাথে জীবন সৃষ্টির সম্পর্ক বীজও ফলের মত। এ প্রসূত প্রসূন সম্পর্ক রয়েছে বলেই জীবিকা উৎপাদনের হাতিয়ার ও পদ্ধতি পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবন দৃষ্টি বা জীবনদর্শনেরও পরিবর্তন ঘটে। মানুষের জীবনধারণের ক্ষেত্রে যে কৃৎকলাকৌশলের প্রয়োগ তা থেকেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন প্রযুক্তিবিদ্যা। প্রযুক্তিবিদ্যা হচ্ছে মানুষের কার্মিক দিক। এ কার্মিক দিকের সম্প্রসারণের মাধ্যমেই মানবজীবন টিকে থাকে। অর্থাৎ, কার্মিক উপযোগের ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের জীবনধারা পরিচালিত হয়। সেজন্যই সামাজিক জীবনে সাংস্কৃতিক প্রভাব এত তীক্ষ্মভাবে পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানবজীবনের উপর সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । সমাজবাসীর পূর্ণ জীবন প্রকাশই সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি ব্যক্তি মানুষের জীবনে চেতনা ও অচেতন এ দু’ভাবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মানবজীবনের সাংস্কৃতিক পরিবেশ, জীবতাত্ত্বিক বংশগতি প্রভৃতির কারণে সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে এর উপর।