বাংলাদেশের শহুরে সমাজের সংস্কৃতি তুমি কিভাবে বিশ্লেষণ করবে?

অথবা, বাংলাদেশের নগর সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত কর।
অথবা, বাংলাদেশের নগর সংস্কৃতির বিবরণ দাও।
অথবা, বাংলাদেশের শহুরে সংস্কৃতি সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, বাংলাদেশের শহুরে সংস্কৃতির বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সংস্কৃতি একটি ব্যাপক প্রত্যয়। সভ্যতার বাহন হলো সংস্কৃতি। “Every man has his own culture.” অর্থাৎ, প্রত্যেক মানুষেরই সংস্কৃতি আছে। একজনের সংস্কৃতি অন্যের চেয়ে আলাদা। প্রত্যেক মানুষ ও গোষ্ঠীর নিজস্ব জীবনধারণের পদ্ধতি রয়েছে, এটিই তার সংস্কৃতি। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তুলতে সংস্কৃতির জুড়ি নেই। সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবন প্রণালি সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।
বাংলাদেশের শহুরে সমাজের সংস্কৃতি : বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির ন্যায় শহরেও নানা শহুরে সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। শহর সমাজে একক পরিবার ও সম্প্রসারিত দম্পতিভিত্তিক পরিবারের প্রাধান্য দেখা যায়। গ্রামের পরিবারগুলো ‘উৎপাদনের একক’ কিন্তু শহুরে পরিবারগুলোকে এক্ষেত্রে ‘ভোগের একক’ বলা যায়। কেননা, শহরে পরিবারস্থ লোকেরা একত্রে খাওয়াপরা ছাড়া অন্যকোনো অর্থনৈতিক কাজ পরিবার হিসেবে একত্রে করে না। শহুরে সংস্কৃতিতে পরিবারের সদস্যগণকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। সেজন্য পরিবারের এক একজন সদস্য এক এক কর্মের ও দক্ষতার অধিকারী। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের এক একটা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। শহরে বাসস্থানের অকুলান হওয়ায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি প্রবণতা থাকে না। কারণ বেশিসংখ্যক সদস্য থাকলে অর্থনৈতিক ও নানাবিধ অসুবিধা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শহুরে সংস্কৃতিতে পরিবারগুলোতে সাংস্কৃতিক জীবনের কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। শহরে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার যেমন একটা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়, গ্রামে তা হয় না। বিভিন্ন পেশাজীবীগণ তাদের নিজ নিজ পেশার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াসী। সেজন্য অন্যান্য পেশায় পরিবারগুলোর সাথে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে না। আধুনিক যুগে শহর সংস্কৃতিতে বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতার সাথে সরাসরি যোাগযোগ ঘটছে। শহরের পরিবারগুলোর মাঝে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া বিজ্ঞান চর্চা এবং নানারকম বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে ধর্ম সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। শহর সমাজের পরিবারের মাঝে এ পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায়। গ্রামীণ পরিবারের চেয়ে শহুরে পরিবার এ ক্ষেত্রে অনেকটা সংস্কারমুক্ত। নগর সংস্কৃতিতে পরিবারের সদস্যদের পরিচিতি গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক পরিবারের চেয়ে ভিন্নতর। শহুরে শিক্ষা- সংস্কৃতি ও কর্মদক্ষতার উপর পরিবারের সদস্যদের সামাজিক পরিচিতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। শহর সমাজে ও পরিবারে স্ত্রীর অর্থনৈতিক ভূমিকা থাকায় বিয়ের পাত্রী নির্বাচনে শিক্ষাদীক্ষা ও কর্মক্ষমতা বিশেষভাবে বিবেচিত হয়। পারিবারিক জীবনে নারীর অর্থনৈতিক এরূপ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে যৌতুকের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, যদিও বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরুদ্ধে জোড় প্রতিবাদ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের শহরের পরিবারগুলোর
অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার। সেজন্য শহরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে পরিবারগুলো অগ্রগামী। বর্তমানকালে শহর সমাজে পরিবারের সকলেই আয়ের উৎস খুঁজে পায়। ফলে পিতামাতা দিনের বেশির ভাগ সময় অফিস- আদালত, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান প্রভৃতিতে কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেজন্য শহুরে পরিবার অনেকক্ষেত্রে সময়ের অভাবে পিতামাতা সন্তানের শ িক্ষার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে কোনোকিছু করার অবকাশ পান না। তাই সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখেন। তাছাড়া বর্তমানে নার্সারি, কিন্ডার গার্টেন ও প্রাইমারী স্কুল প্রভৃতি শিক্ষায়তনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে পিতামাতা ছেলেমেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করা সমীচীন মনে করেন। আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে সাম্যের আদর্শ সমাজের সর্বস্তরে প্রভাব বিস্তার করেছে। পরিবারও এ প্রভাব হতে মুক্ত হতে পারে না। বিভিন্ন পারিবারিক সম্পর্কে সাম্যনীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। যেমন- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বা পিতা পুত্রের সম্পর্ক। পূর্বে স্বামী বা পিতা পারিবারিক বিষয়ে যে আধিপত্য ভোগ করবে বর্তমানে তা সব সমাজেই অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। অনেক কারণে এ পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবধারার সম্প্রসারণ অন্যতম কারণ। গ্রাম্য সমাজে পরিবারের সদস্য সংখ্যা সীমিত রাখার ব্যাপার অনেকে এখনও সচেতন হয়নি। কিন্তু শহর বা নগরে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের প্রতি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের সংস্কৃতির কাঠামোগত ও কার্যাবলির যে বিশেষত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছি তা থেকে বলা যায় যে, বাংলাদেশের পারিবারিক সাংস্কৃতি কাঠামো ও বিভিন্ন কার্যক্রম বস্তুতপক্ষে অর্থনৈতিক অবস্থা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী গ্রাম সমাজের পরিবারের মাঝে পরিবর্তন ঘটছে। তবে শহর বা নগরে সাংস্কৃতিক এ পরিবর্তন ভিন্নমুখী বলা চলে। এ ব্যাপারে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি বা সভ্যতা এবং বাঙালি জাতি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য গ্রাম বাংলার জনজীবন ও তার পরিবর্তন জানা একান্ত প্রয়োজন ।