অথবা, Emile Durkheim এর ধর্মের ক্রিয়াবাদী মতবাদটির ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, Emile Durkheim এর ধর্মের ক্রিয়াবাদী মতবাদটি সমালোচনাসহ আলোচনা কর।
অথবা, Emile Durkheim এর ধর্মের ক্রিয়াবাদী মতবাদটি সমালোচনাসহ বর্ণনা কর।
অথবা, Emile Durkheim এর ধর্মের ক্রিয়াবাদী মতবাদটি সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ধর্ম সম্পর্কিত যেসব ক্রিয়াবাদী প্রবক্তা রয়েছেন তাদের মধ্যে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী Emile Durkheim এর ধর্ম সম্পর্কিত তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলাবাহুল্য, প্রাথমিক ক্রিয়াবাদী তথা সমাজবাদী প্রবক্তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর তত্ত্বের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণ সমাজ বা গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে দেখা দেয় এবং সমাজ সংগঠনই এর উদ্ভবের মূল উৎস।
Durkheim এর ধর্ম সম্পর্কিত ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব : ডুর্খেইম এর ধর্ম সম্পর্কিত ক্রিয়াবাদী তত্ত্বে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। এগুলো হলো :
ক. বিশ্বাস (Beliefs),
খ. আচার অনুষ্ঠান (Rituals),
গ. প্রতীক (Symbols).
Styp Durkheim বলেছেন, ধর্ম হলো কতকগুলো বিশ্বাস, আচার অনুষ্ঠান ও প্রতীকের সমষ্টি, যা সমাজের প্রয়োজনে উৎসারিত ।
ক. বিশ্বাস (Beliefs) : Durkheim এর মতে, ধর্ম হলো পবিত্র বস্তুর ক্ষেত্রে কতকগুলো বিশ্বাস ও কুসংস্কার আচরণ প্রণালি । তিনি বলেছেন, “All religions involve regular ceremonial and ritual activities in which a group of believers meet together.” পবিত্র বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্বাস ও আচরণের অনুগামী মানুষ সংযুক্তভাবে একটি সুসংবদ্ধ নৈতিক জনগোষ্ঠীর গঠন করে। চার্চ হলো এ রকম জনগোষ্ঠীর অন্যতম রূপ। এভাবে জগৎ সংসারে দু’টি অবস্থার জন্ম নিয়েছে :
১. পবিত্র (Sacred), ২. অপবিত্র (Profane)।
এ পবিত্র জগতের বিশ্বাসের বিভিন্নতাই ধর্মের বিভিন্নতার কারণ ।
খ. আচার আচরণ (Rituals) : আচার অনুষ্ঠান সমাজ বা গোষ্ঠীর মানুষকে পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সাহায্য করে। তাই এসব আচার অনুষ্ঠান পূজা অর্চনা বা উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু প্রভৃতি স্তরে পালন করা হয়ে থাকে।
গ. প্রতীক (Symbols) : ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কতকগুলো বিষয়কে ধর্মের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেমন— টোটেম (Totem) প্রথা। আদিম সমাজে টোটেম গোষ্ঠীবদ্ধতার বিশেষ অঙ্গ বা প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়। Durkheim, “A Totem was originally an animal or plant taken as having particular symbolic significance for a group.”
Durkheim ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশকে দু’টি দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। যথা :
১. ধর্মের কাঠামোগত দিক
২. ধর্মের ক্রিয়াগত দিক।
১. ধর্মের কাঠামোগত দিক : ধর্মের কাঠামোগত দিক খুঁজতে গিয়ে তিনি ধর্মকে একটি সম্পূর্ণ সামাজিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি আদিম সমাজের সহজ সরল গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের নানা প্রকার অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি সাধারণ তত্ত্বে উপনীত হন। তিনি ধর্ম নিয়ে গবেষণায় আদিম অস্ট্রেলিয় উপজাতি
‘Arienta’ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে দেবদেবী, ভূতপ্রেত ইত্যাদিতে বিশ্বাস ধর্মের উৎপত্তির জন্য দায়ী নয়, বরং সমাজের প্রয়োজনে, ব্যক্তির প্রয়োজনে নানারকম উৎসবাদী পালনের মাধ্যমে ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে তিনি বলেছেন, ধর্ম বিশ্বাসগুলো একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত ধারণা থেকে উদ্ভূত। তিনি আদিম মানুষের মাঝে এরূপ বিশ্বাস সৃষ্টির অন্তরালে ‘Totem’ বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন Totem’ হলো আদিম মানুষের সামাজিক ও গোষ্ঠী জীবনের বাস্তব ভিত্তি। তিনি বলেছেন, আদিম মানুষ ‘Totem’ কে পবিত্র বলে মনে করত। এ পবিত্র এবং অপবিত্র জগতের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে ধর্ম বিকাশলাভ করেছে।
২. ধর্মের ক্রিয়াগত দিক : Durkheim বলেছেন, ধর্ম একটি সর্বজনীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা সর্বকালে সর্বস্থানে রয়েছে। ধর্মের ক্রিয়াশীলতা তাঁর আলোচনার প্রধান প্রতিপাদ্য । তিনি বলেছেন, “Religion was not to be explained as
something based on errors and lies but as a social reality which answers to the given conditions of human life existence.” [The Elementary forms of Religious Life, p-15] তাঁর মতবাদ থেকে প্রাপ্ত ধর্মের সামাজিক ক্রিয়াশীলতার কিছু কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. সামাজিক সংহতি : ধর্ম মানুষকে একটি আদর্শে, একটি বিশ্বাসে প্রলুব্ধ করে। ফলে স্বভাবই মানুষের মাঝে আদর্শগত মতানৈক্য না থাকায় সংহতি সৃষ্টি হয়। সমাজ জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাবে সমাজ হয় সুসংহত ও বসবাসযোগ্য।
২. নিরাপত্তাবোধ : ব্যক্তি যখন তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে অনেকটা হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন ধর্ম তার মাঝে নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে, যা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
৩. সামাজিক শান্তি ও সুস্থিরতা : ধর্মের মাধ্যমে মানুষ তার পার্থিব জীবনের অনেক কষ্টকর অভিজ্ঞতা ভুলে থাকতে পারে বলে সামাজিক বিক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি স্বভাবতই কম হয়।
৪. অপরাধবোধ : ধর্মে অন্যান্য কার্যকলাপজনিত অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্তমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ থাকায় মানুষ সামাজিক বিধিবহিঃর্ভূত আচার আচরণ এবং সামাজিক অনুশাসন লংঘন করে বিবেকের দংশন অনুভব করে। ফলে পরবর্তীতে এ ধরনের আচার আচরণে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
৫. সামাজিক রীতি : ধর্ম সামাজিক রীতিকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে প্রচলিত মূল্যবোধ, আদর্শ ও রাজনীতির প্রতি সমর্থন দান করে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
সমালোচনা : অনেকে Durkheim এর মতবাদকে একপেশে বলে মনে করেন। কারণ-
১. তিনি ধর্মকে সমষ্টির ব্যাপার বলে চিহ্নিত করেন। অপরদিকে, ধর্মের সাথে ব্যক্তির সম্পর্ককে অবজ্ঞা করেন। ধর্ম শুধু সমষ্টিগত ব্যাপারে নয় ।
২. মানুষ পৃথক পৃথকভাবে এবং নির্জনে একাকী ধর্মের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। আদিম মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস ও আচার পদ্ধতির দিক গির্জার (Church) পর্যায়ে পড়ে না।
৩.বস্তুত কোনো জোটের অস্তিত্ব ছাড়াই আদিম মানুষ ধর্মকে অনুভব করত। সামাজিক ছাড়াও ধর্মের মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে। কিন্তু Durkheim সেটি এড়িয়ে গেছেন।
৪. আদিম মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে জাদুবিদ্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। Durkheim এর মতে, ধর্মে জাদুবিদ্যার প্রভাব ঠিক নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ধর্মের ক্রিয়াবাদী তত্ত্ব সম্পর্কে Durkheim যে মতামত দিয়েছেন, সেটির কিছু সমালোচনা থাকলেও গুরুত্বকে কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তার বাস্তবতা আজও পরিলক্ষিত হয়। ধর্ম মূলত বিশ্বা
ও কতকগুলো আচার আচরণের সমষ্টি তার একথা সর্বজনস্বীকৃত।