সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধসমূহ আলোচনা কর ।

অথবা, সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধসমূহ কী কী? বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধসমূহ বিশ্লেষণ করে দেখাও।
অথবা, সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধসমূহ উল্লেখপূর্বক বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : প্রতিটি পেশার ন্যায় সমাজকর্ম পেশারও কতকগুলো মূল্যবোধ রয়েছে। সমাজকর্মীদের এই মূল্যবোধ অনুসরণ করে কাজ করতে হয় । মূল্যবোধ সমাজকর্ম অনুশীলনের Guideline বা Principle হিসেবে কাজ করে ।
সমাজকর্মের সাধারণ মূল্যবোধসমূহ : সমাজকর্ম অনুশীলনে সমাজকর্মীগণ কতকগুলো সাধারণ মূল্যবোধ অনুসরণ
করেন । সমাজকর্মের এ সাধারণ মূল্যবোধগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার (Right of self determination) : মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্য নির্মাতা । আর মানুষকে তার নিজের ভাগ্য নির্মাণে সুযোগ প্রদান বা অধিকার দান হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার । এটি সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত। সমাজকর্ম মানুষকে তার চাহিদা, পছন্দ, সামর্থ্য ও ক্ষমতানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দানে ও সমস্যা সমাধানে তার নিজের ভূমিকা পালনে বিশ্বাসী । একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া হিসেবে
মানুষ নিজেরাই যাতে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয় সমাজকর্ম সে নীতিতে বিশ্বাস করে। এ লক্ষ্যে সমাজকর্ম ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশসাধনে তৎপর হয় এবং সে অনুযায়ী তাকে সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে ব্যক্তি তার নিজের সমস্যা যতটুকু কার্যকরী সমাধান দিতে পারেন অন্য কারও পক্ষে তা সম্ভব নয় । এ কারণে সাহায্যার্থীকে সাহায্য করে। সমাজকর্মীগণ সাহায্যার্থীকে তাদের যোগ্যতা, মেধা, সম্পদ, শক্তি ও সামর্থ্যের
ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তুলতে সাহায্য করে। সমাজকর্মের এ মূল্যবোধটি সাহায্যার্থীকে পরনির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। জোর করে সাহায্যার্থীর উপর কিছু চাপিয়ে দেয়া সমাজকল্যাণের নীতিমালা ও মূল্যবোধ পরিপন্থী ।
২. ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি (Dignity of mans) : সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হলো ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি’ প্রদান। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তার আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি প্রদানই এর মূল কথা। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে সমাজের প্রত্যেকেই পৃথক মর্যাদা ও সত্তার অধিকারী । সমাজকর্ম জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের বিশেষ মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতিদানে বিশ্বাসী। এভাবে সকল মানুষের বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতিদানের বিশ্বাস হলো ‘ব্যক্তি মর্যাদার স্বীকৃতি’ ।
৩. সকলের সমান সুযোগ (Equal opportunity to all) : সকলের সমান সুযোগ প্রদান সমাজকর্মের একটি নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃত । এ মূল্যবোধের ফলে সমাজকর্ম নারী-পুরুষ, জাতি, বর্ণ, ছোট-বড় সকলকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে এবং সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে বৈষম্যহীনতায় বিশ্বাস করে। ফলে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করা সহজ হয়। সকল স্তরের মানুষ যাতে তার যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ক্ষমতা বা সামর্থ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ সুবিধায় সমানাধিকার লাভ করে সমাজকর্ম সেদিকে গুরুত্বারোপ করে। সমাজের সকল মানুষ তার সামর্থ্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সমান সুবিধা লাভের দাবিদার। সকলের সহজাত প্রয়োজন পূরণ করে একটি কল্যাণমুখী সমাজ
প্রতিষ্ঠার্থে সমাজকল্যাণে ‘সকলের সমান সুযোগ দান’ একটি নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃতি ।
৪. স্বনির্ভরতা অর্জন (Self sufficient) : স্বনির্ভর প্রত্যয়টির অর্থ হলো নিজের উপর নির্ভর করে চলা । আর অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলার প্রচেষ্টাকে বলা হয় স্বনির্ভরতা। অপরের সাহায্য-সহানুভূতি লাভের আশায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে, নিজ প্রচেষ্টায় ও নিজ সামর্থ্যে সক্ষমতা অর্জনকে বলা হয় স্বনির্ভরতা। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে, প্রত্যেক মানুষের ভিতরে রয়েছে সুপ্ত সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত
পরিবেশ । যথার্থ পরিবেশ পেলে অন্যের অনুকম্পার জন্য বসে না থেকে মানুষ নিজে তার নিজের কল্যাণে ব্রতী হতে পারে । এতে একজন ভিখারীর হাত কর্মীর হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। সমাজকর্ম মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যানুযায়ী এমনভাবে সাহায্য করে, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের সুযোগ পায়। এভাবে আত্মনির্ভরশীলতা বা স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে সমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হয়। এ কারণে সমাজকর্মে ‘স্বনির্ভরতা অর্জন’ একটি নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃত । সমাজকর্ম পরনির্ভরশীল মন-মানসিকতার
পরিবর্তে নিজ প্রচেষ্টা ও সামর্থ্যের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের নীতিতে বিশ্বাসী । প্রকৃতপক্ষে, স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমেই
মানুষ কর্মে পরিতৃপ্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। নিজ প্রচেষ্টার বড় হওয়ায় আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় হলেই মানুষ স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়।
৫. গণতান্ত্রিক অধিকার (Democratic rights) : জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কতকগুলো সুযোগ ও অধিকার অবশ্যই জরুরি। মানবজীবনের এসব অধিকারের মধ্যে একটি হলো গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকার ব্যক্তির স্বাধীনচেতনা বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে। সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে এটি স্বীকৃত ।
গণতান্ত্রিক অধিকার হলো এমন অধিকার, যা মানুষকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশে, সমান অধিকার ভোগ করতে, ন্যায়বিচার পেতে ও সহজাত প্রয়োজনগুলো ন্যায়সংগতভাবে পূরণ করতে সাহায্য করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিরিখে আইনের চোখে সকলেই সমান অধিকার ও মর্যাদা লাভের অংশীদার। গণতান্ত্রিক পরিবেশে প্রত্যেকেই নিজ নিজ অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় । নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, ভোট প্রদান করা, সুযোগ সুবিধার
ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাওয়া, সুবিচার প্রত্যাশা করা, কল্যাণ কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া এগুলো গণতান্ত্রিক অধিকার । এর মূল কথাই হলো প্রত্যেক মানুষ অধিকার ও কর্তব্যে সমান এবং গুরুত্বের দিক থেকেও সমান। এ কারণে ব্যক্তি স্বার্থ সংরক্ষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। এটি মানুষের অধিকার সংরক্ষণ ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ প্রশস্ত
করতেও সাহায্য করে।
৬. শ্রমের মর্যাদা (Dignity of labour) : পৃথিবীর সকল কার্যসম্পাদনের প্রথম হাতিয়ার হলো শ্রম । এ শ্রম হলো দিন মজুরের, ‘শ্রমিকের; পেশাজীবীর এবং সকল মানুষের প্রচেষ্টা। কার্যসম্পাদনের উদ্দেশ্যে সকল মানুষের প্রচেষ্টাই হলো শ্রম। সমাজকর্মে ‘শ্রমের মর্যাদা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃতি । ব্যক্তি জীবনের উন্নয়ন ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য শ্রমের মর্যাদার প্রভাব অপরিসীম। এ কারণে কোনো শ্রমকেই অবজ্ঞার দৃষ্টি দেখা উচিত
নয় । সমাজকর্ম শ্রমের যথাযথ মর্যাদাদানে বিশ্বাসী ।
৭. সম্পদের সদ্ব্যবহার (Proper utilities of wealth) : সমাজকর্ম কতগুলো বিশেষ মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত । যেসব ধারণা, বিশ্বাস এবং আদর্শ সমাজকর্মীদের পেশাগত আচরণ পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোর সমষ্টি হলো সমাজকর্মের নীতিমালা ও মূল্যবোধ। সম্পদের সদ্ব্যবহার সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ ।
৮. পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ (Mutual respectness) : কারো কথা বা আচরণ বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হলেও তা
সহ্য করার মতো ধৈর্য অর্জন করা হলো সহনশীলতা। আর মানুষের সামাজিক ভূমিকা পালন ও পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শনই হলো শ্রদ্ধাবোধ। সমাজকর্মে ‘পারস্পরিক সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃত । সমাজকর্মে পেশাগত সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করতেও এ মূল্যবোধের প্রয়োজন অনুভূত হয়। কেননা সমাজকর্মের সমস্যার সমাধান প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন । আর এর জন্য সমাজকর্মী ও সাহায্যার্থীর মধ্যে এ মূল্যবোধের অভাব ঘটলে পুরো সাহায্য প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয় ।
৯. সামাজিক দায়িত্ব (Social responsibilities) : সমাজকর্মের সামাজিক দায়িত্ব পালনের মূল্যবোধে বিশ্বাসী
সমাজের প্রত্যেক মানুষকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি, নিজের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয় ।
১০. ব্যক্তিস্বাধীনতা (Individual freedom) : সমাজকর্মের একটি মূলনীতি হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী কাজ করে তবেই ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব। আর সমাজকর্ম ব্যক্তিত্বের বিকাশের লক্ষ্যেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে ।
১১. গোপনীয়তা (Confidentiality) : গোপনীয়তার নীতি হলো, সমাজকর্মী ও সাহায্যপ্রার্থীর মধ্যকার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য চুক্তি । সাহায্যপ্রার্থী যেন নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে তথ্য প্রকাশ করতে পারে সমাজকর্মীকে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সমস্যার মূল কারণ উদ্ঘাটিত হবে এবং সমস্যার সঠিক সমাধান হবে। তথ্যের গোপনীয়তার জন্য
সাহায্যপ্রার্থীর ফাইল সতর্ক অবস্থায় রাখতে হবে যাতে কেউ তা দেখার সুযোগ না পায়’। (করিম রেজাউল : ২০০৭)
১২. গ্ৰহণ নীতি (Principles of acceptance) : “সমাজকর্মের একটি বিশেষ নীতি হলো গ্রহণের নীতি । এটা সামগ্রিক সমস্যার সমাধান বা সেবা সহায়তার কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজকর্ম সেবা সহায়তায় সমাজকর্মী ও সাহায্য প্রার্থীর পারস্পরিক গ্রহণ ও সুসম্পর্ক স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেবা সহায়তার কৌশল বিশারদ এবং পেশাদার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাজকর্মীকেই পারস্পরিক গ্রহণের মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পেশা হিসেবে সমাজকর্ম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী । কারণ এখানে সাহায্য প্রার্থীর মতামত, অংশগ্রহণ, ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ইত্যাদি নীতি কৌশল অনুসরণ করা হয়। যা সমাজকর্মকে অন্যান্য সকল পেশা থেকে স্বাতন্ত্র্য করে তোলে ।