সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও।
অথবা, সংস্কৃতি কী?
অথবা, সংস্কৃতি বলতে কী বুঝ?
অথবা, সংস্কৃতি কাকে বলে?
অথবা, সংস্কৃতির কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। আর এ সমাজবদ্ধ জীবের অন্যতম বড় পরিচয় হলো তার সংস্কৃতি; যার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রা হয় বৈচিত্র্যময়, সুন্দর ও মার্জিত। সমাজতত্ত্বে সংস্কৃতি শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সংস্কৃতি বলতে মানুষের শ্রম ও মেধার ভিত্তিতে বৈষয়িক ও মানস সম্পদের সমষ্টিকে বুঝায়। জীবনবোধ ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের স্বার্থে মানুষ ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি করে চলেছে বিভিন্ন বৈষয়িক সম্পদ ও মানস সম্পদ। সংস্কৃতি হলো মানুষের বৈষয়িক সম্পদ ও মানস সম্পদের সংমিশ্রিত প্রকাশ। সমাজ, জাতি, দেশ প্রভৃতিভেদে সংস্কৃতির ধরন ও বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয়।
সংস্কৃতি (Culture) : ব্যুৎপত্তিগত অর্থে, ইংরেজি ‘Culture’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ‘সংস্কৃতি’। ইংরেজি Culture’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Colere’ থেকে এসেছে। ‘Colere’ শব্দটির অর্থ হলো ‘কর্ষণ করা’। সর্বপ্রথম ইংরেজি সাহিত্যে ‘Culture’ শব্দটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সিস বেকন ষোল শতকের শেষার্ধে। সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে একটি জাতির আচার আচরণ, মূল্যবোধ, খাওয়া, পরা, কথা বলা, চলাফেরা, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদির আবেগিক বা মানসিক অবস্থাকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, সংস্কৃতি হলো চিন্তার ক্রিয়াশীল এবং সৌন্দর্য ও মানবিক অনুভূতিতে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
সমাজবিজ্ঞানী জোনস (Jones) এর মতে, “মানবসৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।” (Culture is the sum o man’s creations.) সমাজবিজ্ঞানী জে. এম. শেফার্ড (J. M. Shephard) বলেছেন, “মানবসৃষ্ট সকল বস্তু এবং সমাজের সদস্যদের মধ্যে বংশপরম্পরায় বর্তিয়ে থাকে এমন সকল চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা এবং আচার ব্যবহারের ধরনই হচ্ছে সংস্কৃতি।”
সমাজবিজ্ঞানী রস (Ross) এর মতে, “সকল বস্তু ও অবস্তুগত কৌশল হচ্ছে সংস্কৃতি।” (Culture is the total acquired behaviour patterns transmitted by imitation on instruction.)
সমাজবিজ্ঞানী কুলি, এঞ্জেল এবং কার (Cooley, Angel and Carr) বলেছেন, “একত্রে বাস করার ফলশ্রুতি, যা বংশপরম্পরায় উৎকীর্ণ করা যায় তাকেই সংস্কৃতি বলা হয়।” (Culture is the sum total of transmittable result of living together.)
বিখ্যাত মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী আর. এম. ম্যাকাইভার (R. M. MacIver) এর মতে, “আমরা মানুষ হিসেবে কি, সে হলো আমাদের সংস্কৃতি।” সংস্কৃতির বহুল আলোচিত সংজ্ঞাটি প্রদান করেছেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী ই. বি. টেইলর (E. B. Tylor)। তিনি তাঁর ‘Primitive Culture’ গ্রন্থে বলেছেন, “জ্ঞানবিজ্ঞান, আচার বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইনকানুন এবং অনুশীলন ও অভ্যাস যেসব মানুষ কোনো এক সমাজের পরিবেশে আয়ত্ত করে সেসবের সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।” সমাজবিজ্ঞানী বায়ারস্টেড (Biarsted) এর মতে, “সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জটিল সমন্বয়, যা সমাজের সদস্য হিসেবে একজন মানুষ চিন্তা করে, কোনোকিছু করে এবং যা তাদের থাকে।”
সমাজবিজ্ঞানী বি. ম্যালিনস্কি (B. Malinowski) বলেছেন, “সংস্কৃতি মানুষেরই সৃষ্ট, যার মাধ্যমে সে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করে।”
‘Encyclopaedia of Social Science’ এ বলা হয়েছে, “সংস্কৃতি মানুষের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যবহারিক শিল্প, দ্রব্যসামগ্রী, কারিগরি প্রণালি, ধারা, অভ্যাস ও মূল্যবোধ।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, মানুষের সামগ্রিক জীবনধারাই হলো সংস্কৃতি। এটি হলো সমাজ ও সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের অজস্র বিষয়ের এক জটিল ও মিশ্র রূপ, যার মধ্যে রয়েছে সমাজের সমষ্টিগত জ্ঞান, নীতিবোধ, বিশ্বাস, আইন, কলা, প্রথা ইত্যাদি এবং সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের যে কোনো বিষয়ে অর্জিত দক্ষতা ও অভ্যাস।