সংশোধনমূলক কার্যাবলির সংজ্ঞা দাও। সংশোধনমূলক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্য এবং এর যৌক্তিকতা আলোচনা কর।

অথবা, সংশোধনমূলক কার্যাবলি কী? সংশোধনমূলক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্য ও উপযোগিতা বর্ণনা কর।
অথবা, সংশোধন কী? সংশোধনমূলক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ কর।
অথবা, সংশোধন কাকে বলে? সংশোধনমূলক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ কর।
অথবা, সংশোধনবাদ বলতে কী বুঝ? সংশোধনমূলক কার্যাবলির যৌক্তিকতাসমূহ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পৃথিবীতে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তার চারপাশের পরিবেশ, আচার আচরণ, রীতিনীতি তাকে ধীরে ধীরে অপরাধী করে তোলে। আবার কখনো কখনো কোন বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যক্তি অপরাধ করতে বাধ্য হয়। যদিও অনেক অপরাধবিজ্ঞানী বলেছেন যে, মানুষ অপরাধ করার প্রবণতা জন্মগতভাবে পেয়ে থাকে যা মানুষের বিভিন্ন প্রকার শারীরিক বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন প্রকার অপরাধের জন্য দায়ী। কিন্তু এ মতামত আজ উপেক্ষিত। তাই আজ অপরাধীকে সরাসরি শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে সমাজে পুনর্বাসিত করার জন্য সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সংশোধন : সাধারণ অর্থে শাস্তির পরিবর্তে যে পন্থা বা পদ্ধতি অনুসরণ করে অপরাধীদের চরিত্র সংশোধনের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সমাজ থেকে অপরাধ হ্রাস করার ব্যবস্থা করা হয়, তাকে সংশোধনমূলক কার্যাবলি বুঝায়। আধুনিক ‘আচরণবাদ’ সংশোধনমূলক এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দর্শনের উপর অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করেছে। কারণ আচরণবাদীদের মতে, ব্যক্তি নয় পরিবেশই ব্যক্তিত্বের প্রধান নির্ণায়ক। অর্থাৎ উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে যে কোনো প্রকার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সংশোধনমূলক কার্যাবলি ও অপরাধীদের সংশোধনের জন্য তাদের আচরণে গঠনমূলক পরিবর্তন আনয়ন করে থাকে । আর এজন্যই সংশোধনমূলক কার্যাবলিতে মনোচিকিৎসা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজকর্ম প্রয়োগ করা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানী Robert L. Barker তাঁর The Social Work Dictionary’ (P-81) গ্রন্থে বলেছেন, ‘The legal speciality that seeks to change and improve the
behaviour of convicted law offenders through in correction puerile, probation and ideally educational programmes and social services.”
আবার The Dictionary of Social Welfare (P-51) এ সংশোধন সম্পর্কে বলা হয়েছে, “Correction is the process of reforming rehabilitating (young) delinquents.”
উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে যেসব কার্যক্রম এবং কৌশলের মাধ্যমে অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা মুক্ত করে স্বাভাবিক সমাজজীবনে পুনর্বাসনে সহায়তা দান করা হয় সেসবের সমষ্টিকে সংশোধনমূলক কার্যক্রম বলে। অপরাধীদের চরিত্র সংশোধন উপযোগী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উপদেশ, নির্দেশনা, সামাজিক সুযোগ সুবিধা প্রদান সংশোধনমূলক কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।
সংশোধনমূলক কার্যাবলির বৈশিষ্ট্য : নিম্নে সংশোধনমূলক কার্যাবলির কতিপয় বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :
১. শান্তি নীতি অস্বীকার : সংশোধনমূলক কার্যক্রম শাস্তি প্রদানের নীতিকে স্বীকার করে না।
২. মানবিক বিচার : সংশোধনমূলক কার্যক্রমে পরাধটিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারবিশ্লেষণ করা হয়।
৩. পারস্পরিক সম্পর্ক উদ্ভাবন : সংশোধনমূলক কার্যক্রমে অপরাধের কারণ অথরা কারণসমূহের মধ্যে পারস্পরিক
সম্পর্ক উদ্ভাবন করা হয়।
৪. চিকিৎসার ব্যবস্থা : এখানে শারীরিক এবং মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত অপরাধীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
৫. অপরাধীর নৈতিক উন্নতি : সংশোধনমূলক কার্যক্রমে অপরাধীর চারিত্রিক এবং নৈতিক উন্নতির চেষ্টা করা হয়।
৬. অপরাধীর পুনর্বাসন : পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অপরাধীকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
৭. অপরাধীদের শিক্ষা প্রদান : সংশোধনমূলক কর্মসূচিতে অপরাধীদের জন্য সাধারণ শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
৮. অপরাধীদের সামাজিক উন্নতি : সংশোধনমূলক কার্যাবলির মাধ্যমে অপরাধীদের মাঝে সামাজিক চেতনা ও
দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা হয়।
৯. যাবতীয় সমস্যা সমাধান : সর্বোপরি অপরাধীদের দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সংশোধনমূলক কার্যাবলির যৌক্তিকতা সংশোধনমূলক কার্যাবলির মূলে যে যুক্তি বা দর্শন রয়েছে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. নৈতিক যুক্তি বা দর্শন : বর্তমান বিশ্ব মানবাধিকারের স্লোগানে মুখরিত। আর বর্তমান এ মানবাধিকারের যুগে সবাই নীতিগতভাবে একথা একবাক্যে স্বীকার করে যে, অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা উচিত। যদিও মানুষের মাঝে ভুলভ্রান্তি, আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদি পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। তবুও এসব উপাদানের তাড়নায় কেহ অপরাধ করে বসলে তাকে শাস্তি দিয়ে সমাজের ভুল করা উচিত নয়, বরং সংশোধনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সহায়তা করাই অধিক শ্রেয়। বর্তমান কালে শাস্তির চেয়ে সংশোধনমূলক ব্যবস্থাকেই অপরাধ দমনে অধিক কার্যকর মনে করা হয়।
২. সামাজিক যুক্তি : অপরাধবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অপরাধ হচ্ছে একটি জটিল সামাজিক সমস্যা এবং প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশই অপরাধ প্রবণতার পিছনে ক্রিয়াশীল। কারণ পরিবেশ গঠনমূলক এবং অনুকূল হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস করা যায়। কাজেই অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা উচিত।
৩. অর্থনৈতিক যুক্তি : একটি সমাজের মানুষ যখন মৌলিক মানবিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে সক্ষম হয় না তখন শুধু জীবনধারণের তাগিদে অনেকে বাধ্য হয়েই অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ আর্থিক দৈন্যতা মানুষকে অপরাধী করে তোলে। তাই তাকে আর্থিক দৈন্যতা থেকে মুক্ত করতে পারলে নিঃসন্দেহে সেও স্বাভাবিক জীবনযাপন
করবে। সুতরাং অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে সংশোধনের মাধ্যমে পুনর্বাসন করাই অধিক যুক্তিসংগত।
৪. মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি : কোনো ব্যক্তির অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ার পিছনে মানসিক বিপর্যয়গ্রস্ততা ক্রিয়াশীল। কেননা তার জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, নিরাশা, বঞ্চনা, যন্ত্রণা ইত্যাদি তাকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। এসব ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করলে তার মাঝে আরো অধিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাজেই অপরাধীদের সংশোধনের ব্যবস্থা করার যৌক্তিকতাই সর্বাধিক।
৫. শারীরিক কারণ : অনেক সময় কোনো ব্যক্তির অপরাধ প্রবণতার পিছনে শারীরিক কারণও ক্রিয়াশীল থাকে। অনেক সময় দেখা যায় যে, ত্রুটিপূর্ণ গ্রন্থি, বিকলাঙ্গতা, স্নায়ুতন্ত্রের অবসাদগ্রস্ততা ইত্যাদি শারীরিক কারণে ব্যক্তির মাঝে অপরাধ প্রবণতা দেখা দেয়। অপরাধীর এ অপরাধ সুচিন্তিত অথবা সুপরিকল্পিত নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে অসচেতন মনেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সুতরাং এসব অপরাধীদের শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের সুযোগ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা উচিত।
৬. নির্ভরশীলদের নিরাপত্তার জন্য : অনেক সময় দেখা যায় যে, পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি বিভিন্ন কারণে অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে তাকে শাস্তি দিলে তার উপর নির্ভরশীলরা৷ নিরাপত্তাহীনতার শিকারে পরিণত হয়ে অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং নির্ভরশীলদের নিরাপত্তার জন্য এবং নতুন অপরাধী প্রতিরোধের জন্য অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করাই যুক্তিসংগত।
৭. সমাজে অপরাধের সংখ্যা হ্রাস করার জন্য : বাস্তব প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, কোনো অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হলে পরবর্তীকালে সে আরো অধিক অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। কিন্তু সংশোধন করা হ লে তার দ্বারা নতুন অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সংশোধনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে
অপরাধের সংখ্যা হ্রাস করা যায়। সুতরাং শাস্তির পরিবর্তে অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করাই যুক্তিযুক্ত।
৮. সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য : সংশোধনের মাধ্যমে অপরাধীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ অপরাধীরাও সমাজের সদস্য। অপরাধ প্রবণতার জন্য তাদের চেয়ে সমাজ এবং সামাজিক পরিবেশ অধিক পরিমাণে দায়ী। সুতরাং অপরাধীকে শাস্তি প্রদান না করে সংশোধনের মাধ্যমে তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ প্রদান করাই অধিক বাঞ্ছনীয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শাস্তি প্রদান সত্যিকার অর্থে অপরাধীকে অপরাধ থেকে দূরে সরাতে পারে না, বরং তাকে আরো বেশি অপরাধপ্রবণ করে তোলে। তাই অপরাধ প্রবণতার কারণ বিশ্লেষণ করে তাকে সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে নতুনভাবে পুনর্বাসনের সুযোগ প্রদান করাই অধিক যুক্তিসংগত।