শাস্তির বিভিন্ন ধরন বা প্রকৃতি সম্পর্কে লেখ ।

অথবা, শাস্তির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজে অপরাধের প্রতিবিধানের জন্য শাস্তির উদ্ভব হয়েছে। শাস্তি হলো মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায় । সমাজে বসবাসকারী মানুষ স্বেচ্ছায় তাদের নৈতিকতা ভঙ্গ করে এমন সব কর্ম করে যার ফলে সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানুষের এসব কর্মকে অপরাধ বলা হয়। এ অপরাধমূলক কাজ হলো সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ । এ সমাজ বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবিধান হিসেবে নীতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শাস্তির আলোচনা হয়ে থাকে।
শাস্তির বিভিন্ন ধরন বা প্রকৃতি : যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির প্রথা লক্ষ্য করা গেছে। তবে যুগের বিবর্তনে অনেক শাস্তিই ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে। আবার দুএকটি শাস্তি এখনও টিকে আছে। নিম্নে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. বেত্রাঘাত : আদিমকালে শাস্তির মধ্যে বেত্রাঘাত ছিল সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। প্রথাটি ভারতবর্ষ, ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। আমাদের দেশে বর্তমানে এ প্রথাটি আর নেই। জানা যায় যে, ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকার কোন কোন রাজ্যে এটি স্থায়ী ছিল। ভারতেও এটি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৫ সালে । তবুও আমরা এখনও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রামাঞ্চলে কিংবা পরিবারে এর ব্যবহার দেখতে পাই ।
২. অঙ্গচ্ছেদ : প্রাচীন কালে শাস্তি প্রদানের যত নিয়ম ছিল তার মধ্যে অঙ্গচ্ছেদ অন্যতম। প্রাচীন ভারতবর্ষে দেখা যেত, যে কেউ চুরি করে ধরা পড়লে তার হাত কেটে দেয়া হতো। তবে এ ধরনের শাস্তি অত্যন্ত নির্মম বলে বাতিল ঘোষণা করা হয়। তবে মধ্যপ্রাচ্যে আজও এ আইনের প্রচলন দেখা যায়।
৩. শরীরে ছাপ প্রদান : ইতালি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশে লৌহ পুড়িয়ে অপরাধীর গায়ে ছাপ দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। তবে এর নির্মমতার কারণে এটাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮২৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথাটি সরকারিভাবে বিলোপ (Abolish) করা হয়।
৪. পিলোরি : পিলোরি অর্থ কাঠ নির্মিত শাস্তিস্তম্ভ। এর মধ্যে অপরাধী ব্যক্তির মাথা ও হাত ঢুকিয়ে আটকে রাখার জন্য গর্ত থাকত। এটি নির্মম হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ায় ১৮৩৭ সালে ইংল্যান্ডে এটিকে সরকারিভাবে বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
৫. নির্বাসন : আদিমকালে শাস্তি হিসেবে নির্বাসনে পাঠাত। সাধারণত পলায়নকারী অপরাধী, রাজনৈতিক অপরাধী ইত্যাদিকে নির্বাসনে পাঠানো হতো। নেপোলিয়নকে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল ।
৬. কারাদণ্ড : কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার রীতি সর্বজনীন এবং তা তুলনামূলকভাবে অধিক যুক্তিসঙ্গত। পৃথিবীর সমগ্রদেশে কারাদণ্ডের বিধান আছে। কারাগারে অনেক দেশে অপরাধীদের চরিত্র সংশোধন করে সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
৭. নিঃসঙ্গ কারাবাস : কারাবাসের চেয়ে অধিকতর কষ্টদায়ক শাস্তি হলো নিঃসঙ্গ কারাবাস। এ ধরনের শাস্তির ক্ষেত্রে অপরাধীর সামাজিক জীবনকে সম্পূর্ণভাবে অবদমিত করা হয়। তবে এ প্রথা নিষ্ঠুর ও অমানবিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে ।
৮. অর্থদণ্ড : বর্তমান বিশ্বের প্রায় দেশেই অর্থদণ্ড রয়েছে। সাধারণত ছোটখাটো অপরাধ, কর ফাঁকি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অর্থদণ্ড দুপ্রকার। যথা :
ক. অপরাধের জন্য জরিমানা এবং
খ. কোন বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জরিমানা।
৯. মৃত্যুদণ্ড : সর্বোচ্চ ও চরম কঠোরতম শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। আদিমকাল থেকেই মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত ছিল। মূলত অপরাধ আইনের চরম লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সুস্থ, সুন্দর সমাজ জীবনের জন্য তৈরি হয়েছে আইন এবং উদ্ভব ঘটেছে রাষ্ট্রের। যখন কোন ব্যক্তি কোন নীতিবিরোধী কাজ বা আইন ভঙ্গ করে তখন তাকে বলা হয় অপরাধী। আর অপরাধীর উপর রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত কোন দণ্ড বা সাজাই হলো শাস্তি । শাস্তির আবার বিভিন্ন ধরন রয়েছে। অপরাধের মাত্রার উপর নির্ভর করে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হয়। নানাবিধ সামাজিক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত এবং যেখানে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি হুমকির সম্মুখীন, সেসব দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্যই শাস্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য ।