লিপিবদ্ধকরণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কী?

অথবা, কেস রেকর্ডিং -এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, কেইস রেকডিং এর তাৎপর্যসমূহ লিখ।
অথবা, কেইস লিপিবদ্ধকরণের আবশ্যকতা কী?
অথবা, কেইস রেকডিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
অথবা, লিপিবদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা লিখ।
উত্তর।। ভূমিকা : মানুষের স্মৃতিশক্তি সীমিত। এ কারণে সে যা শোনে, যা দেখে এবং যা পর্যবেক্ষণ করে তার সবটুকুই মস্তিষ্কে ধরে রাখতে পারে না। একজন সমাজকর্মীও তা পারে না। এ কারণে সমাজকর্মী ব্যক্তি ও তার সমস্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করে এবং সেগুলো প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেন।
লিপিবদ্ধকরণের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : নিম্নে লিপিবদ্ধকরণের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
১. সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় : সমাজকর্মী যেসব বিষয়কে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সেসব বিষয় লিখে রাখেন।পরবর্তীতে সেগুলো বিচারবিশ্লেষণ করে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় করতে সক্ষম হন।সমাজকর্মী লিপিবদ্ধ তথ্য থেকে সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারে প্রয়াস চালান।
২. সমস্যার সার্বিক চিত্র উপস্থাপন : লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে সমাজকর্মী সমস্যার সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করেন।সাহায্যার্থী সমস্যা সমাধানে কি ধরনের ভূমিকা রাখছে এবং সমাজকর্মীই বা কি ধরনের দায়িত্ব পালন করছে তা লিপিবদ্ধকরণে উল্লেখ থাকে। অর্থাৎ এতে সবকিছুর ব্যাখ্যা দান করা থাকে।
৩. সার্বিক তথ্য জানা : লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও তার সমস্যা সম্পর্কে সার্বিক তথ্য সন্নিবেশন করা হয়।ব্যক্তির পরিচয়, পেশা, তার সমস্যার প্রকৃতি, তার আয়, ব্যয়, আর্থসামাজিক অবস্থা, মনোদৈহিক অবস্থা, তার পারিপার্শ্বিক
পরিবেশ, তার আচরণ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, দুর্বলতা, সবলতা, সক্ষমতা, অক্ষমতা ইত্যাদি সবকিছুই লিপিবদ্ধকরণে স্থান পায়। মোটকথা ব্যক্তি সম্পর্কে সার্বিক তথ্য জানতে লিপিবদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব রয়েছে।
৪. সমাজকর্মীর জ্ঞান ও দক্ষতা বিকাশে সহায়তা : সমাজকর্মীর জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে লিপিবদ্ধকরণের একটা ভূমিকা রয়েছে। লিপিবদ্ধকৃত তথ্য থেকে পরবর্তী সময়ে সমাজকর্মীগণ তথ্যসংগ্রহ করতে পারেন। এ তথ্য পুরাতন সাহায্যার্থীর সমস্যার স্বরূপ উন্মোচনেও যেমন সাহায্য করে তেমনি বর্তমান সাহায্যার্থীর সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারেও জ্ঞানের উৎস হিসেবে কাজ করে।
৫. সাহায্যার্থীর সমস্যা ও সেবা চাহিদা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য লাভ : লিপিবদ্ধকৃত তথ্য সাহায্যার্থীর সমস্যা নির্ণয় ও তার চাহিদার বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। Mac Gwan এবং Porter (1967) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “Goo case recording provides continuity with respect to all general information, evaluation and services provided. For each interview or case contact the written record provides the point of departure for additional services. Also, when there is a personnel turnover or when more than one person participates in the development of the case, the case record enables each professional participant coordinate his work with that of other professional worker.”
৬. গবেষণার তথ্যের উৎস : গবেষণাকার্যে গবেষকগণ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে যে তথ্যসংগ্রহ করেন তার মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো লিপিবদ্ধকরণ। কেস রেকর্ডিং বা লিপিবদ্ধকরণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির সমস্যা ও চাহিদা অনুধ্যানে সমাজকর্মীকে সহায়তা করা। লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে তথ্যের এমন একটি ভিত্তি গড়ে উঠে যার প্রেক্ষিতে সমাজকর্মী সাহায্য প্রার্থীর বিভিন্ন বিষয় অবহিত হতে পারে এবং যৌক্তিক চিন্তায় বিচারবিশ্লেষণ করে চাহিদা ও সম্ভাব্য সেবা নিরূপণ করতে পারে। Good case recording provides continuity with respect to all general information, evaluation and services provided.
৭. শিক্ষার উপকরণ : লিপিবদ্ধকরণ সমাজকর্মের প্রশিক্ষণার্থীদের বাস্তব ও ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। পূর্ববর্তী কোন সমাজকর্মীর লিপিবদ্ধকৃত তথ্য প্রশিক্ষণার্থীদের পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদির Style সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেয়। এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থী সমাজকর্মীগণ বাস্তবক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করতে পারে।
৮. সেবাগ্রহীতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন : লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে সেবাগ্রহীতার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক,পারিবারিক, মনোদৈহিক ইত্যাদি তথ্য সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়। ফলে সেবাগ্রহীতা সম্পর্কে ধারণা লাভের ক্ষেত্রে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করে।
৯. তথ্যকে ধরে রাখা : লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে ব্যক্তি ও তার সমস্যা সম্পর্কিত প্রাপ্ত তথ্যকে ধরে রাখা যায়।লিপিবদ্ধকরণ ব্যতীত অনেক তথ্যই বিকৃত হতে পারে কিংবা সমাজকর্মী মনে নাও রাখতে পারে। এতে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় ও তার সমাধান দেয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে।
১০. প্রামাণ্য দলিল : লিপিবদ্ধকরণকৃত তথ্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে। এতে সাহায্যার্থীর আবেগ,অনুভূতি, চিন্তাচেতনা, ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দিক সম্পর্কে চমৎকার ধারণা প্রদান করা হয়। এছাড়াও ব্যক্তির সার্বিক অবস্থার একটি বিবরণও এতে তুলে ধরা হয়।
১১. ভবিষ্যৎ সেবা কার্যক্রমের পথ নির্দেশনা দেয় : ভবিষ্যৎ সেবা কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণে কেস রেকর্ড একটি উৎস তথ্য হিসেবে কাজ করে। কেননা তাহলো একটি প্রকাশিত কিংবা অপ্রকাশিত তৎপরতার প্রতিফলিত চিত্র, প্রয়োজন-চাহিদার বিবরণ এবং যা কিছু ঘটেছে সে বিষয়ের বিবৃতি। ফলে কেস রেকর্ড ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের একদিকে পথ নির্দেশক,তেমনি অন্যদিকে একটি ভিত্তি।
১২. এজেন্সি সেবা সম্পর্কিত তথ্য : লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে এজেন্সির সেবা সম্পর্কিত তথ্যও জানা যায়। এজেন্সি সাহায্যার্থীকে কিভাবে সাহায্য করবে, কোন উপকরণ দিয়ে সাহায্য করবে, এজেন্সির সীমাবদ্ধতা কি, এজেন্সির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি ইত্যাদি ধারণা লাভের ক্ষেত্রেও লিপিবদ্ধকরণের গুরুত্ব রয়েছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তি সমাজকর্মে বস্তুত কেসু লিপিবদ্ধকরণ বিভিন্ন দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক হিসেবে পরিচিত।লিপিবদ্ধকৃত তথ্য সমাজকর্মীদের জ্ঞানের উৎস হিসেবে কাজ করে।তাছাড়া এ থেকে তথ্য বিন্যস্তকরণ ও তথ্য বিশ্লেষণের ধারণাও পাওয়া যায়। ব্যক্তির সমস্যাবলির সার্বিক চিত্রাবলি লিপিবদ্ধকৃত তথ্য থেকে জানা যেতে পারে। এর মাধ্যমে সমাজকর্মী শুধু জ্ঞান দক্ষতার বিকাশ ও অধিকতর কার্যকর সেবাদানের ক্ষমতাই অর্জন করে না; একই সাথে পেশাগত বিকাশও ত্বরান্বিত করে নিজেদের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে থাকে।