রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেদান্ত দর্শন আলোচনা কর।

অথবা, বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত বর্ণনা কর।
অথবা, বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷। ভূমিকা :
সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত,উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, যার জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, যাঁকে আকাশের সাথে তুলনা করা হয়, যার বিস্তৃতি বিশ্বজোড়া, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যাদের কণ্ঠে মানবতার জয়গান শোনা যায়, তাঁদের মধ্যে যিনি নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ, যিনি বাংলাদেশ দর্শনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার নাম বাংলার যতদিন অস্তিত্ব থাকবে, যতদিন এ বিশ্ব ধ্বংস না হবে ততদিন রবে সকল মানুষের অন্তরে,তিনিই হলেন বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেননি, অথচ তার চিন্তা যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের বেদান্ত দর্শন : বেদের সর্বশেষ অংশ বলে উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত দর্শন। জীবন ও জগতের সত্যোপলব্ধির অদম্য প্রচেষ্টা ও দার্শনিক বিশ্লেষণ নিয়ে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতীয় দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বেদান্ত দর্শনের সূচনা হয়েছিল। ঈশ্বরের প্রেমাস্বাদনের ও আনন্দ উপভোগের আকাঙ্ক্ষাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের গতিবৈচিত্র্যের মধ্যে প্রাণবন্ত। সৌন্দর্য সাধক রবীন্দ্রনাথ চিত্র পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর গাঢ় সৌন্দর্যের আনন্দ সুধা পান করে অমৃতলোকের তপস্যায় নিমগ্ন হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবন ও জগতের বহুত্বের মধ্যে নিজেকে বিকশিত করে নিখিলের আনন্দযজ্ঞে অংশ নিয়েছেন। ধর্মবোধ সম্পর্কে তাঁর উক্তি লক্ষণীয়, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধিই ধর্মবোধ। জীবের জন্যই তিনি দ্বৈতভাব গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈত-দ্বৈতের মুখাপেক্ষী। ব্রহ্মের আনন্দের জন্যই জগৎ ও জীবের সৃষ্টি। অসীমের মধ্যে সীমা ও প্রেম নেই; অসীম সীমার নিবিড় সঙ্গ লাভ করতে চায় প্রেমাস্বাদনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পরমেশ্বর জীবের সংসর্গ কামনা করেন। জীব ও জগৎ ছাড়া ব্রহ্ম অপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলিতে বলেছেন,
“আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী
তারি সাথে, প্রভু, মিলিয়া তোমার প্রীতি
জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি
আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।”
ঈশ্বর যেমন জীবের মিলন পিয়াসী জীবও তেমন পরমাত্মার জন্য তৃষ্ণার্থ। তাইতো তিনি লিখেছেন,
“পুষ্প যেমন আলোর লাগি
না জেনে রাত কাটায় জাগি
তেমনি তোমার আশায় আমার
হৃদয় আছে ছেয়ে।”
(গীতাঞ্জলি)
রবীন্দ্রনাথের দর্শনের মধ্যেও মানুষের দ্বৈতসত্তার বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একদিকে ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র সত্তা আছে, অপরদিকে তাঁর মধ্যে একটি বিশ্ব পুরুষ আছে। আত্মার মধ্যে যখন ‘বিশ্ব আমি’ এসে দাঁড়ায় তখন সত্যের চিরন্তন রূপ প্রকাশিত হয়। তাইতো তিনি বলেছেন,
“মানুষের আলো জ্বালায়ে তার আত্মা,
তখন ছোট হয়ে যায় তার সঞ্চয়ে অহংকার।
জ্ঞানে, প্রেমে, ভাবে, বিশ্বের মধ্যে
ব্যক্তি দ্বারাই সার্থক হয় সে আত্মা।”
বিশ্ব পুরুষের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন, ব্যক্তিগত অঙ্গটা দেহ সর্বস্ব, এর পঙ্কিল আবরণ মানুষের আত্মার ও যুক্তরূপে আবৃত হয়। তাই কবি তাঁর লেখনীতে লিখেছেন,
“এই দেহখানা বহন করে আসছে দীর্ঘকাল বহু ক্ষুদ্র মুহূর্তের রাগ, দ্বেষ, ভয়, ভাবনা
কামনার আবর্জনারাশি।
এর আবিল আবরণে বারে বারে ঢাকা পড়ে আত্মার মুক্তরূপ।
এ সত্যের মুখোশ পরে সত্যকে আড়াল রাখে, মৃত্যুর কাদা মাটিতেই গড়ে আপনার পুতুল;
তবু তার মধ্যে মৃত্যুর আভাস পেলেই নালিশ করে আর্তকণ্ঠে।”
বেদান্ত দর্শন কৰির জীবনের মর্মমূলে রস সঞ্জীবিত করে এক আধ্যাত্মিক অনুভূতির জগতে নিয়ে গেলেও রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় অনুভবের স্পর্শে আত্মা, পরমাত্মা ও জগতের মহিমা এক ভিন্ন জীবনদর্শনে রূপ নিয়েছে। উপনিষদের সাথে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় আত্মিক সম্পর্কের প্রকৃষ্ট নিদর্শনস্বরূপ কবির উক্তিই উল্লেখযোগ্য-
“এই বিচিত্র জগৎ সংসারকে উপনিষদ ব্রহ্মের অনন্ত সত্যে, ব্রহ্মের আনন্দ জ্ঞানে বিলীন করিয়া দেখিয়াছেন।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্বয়বোধে ব্যক্তিজীবনের ও মহামানবের অখণ্ডতার সাথে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনুবর্তন একই সূত্রে গ্রথিত করে এক অনন্য জীবনদর্শন প্রতিফলিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের রচনায় দেখা যায়, ব্রহ্ম মানুষের নিকট একমাত্র মনুষ্যত্বের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা সত্যরূপে প্রত্যক্ষরূপে বিরাজমান। তিনি সর্বদেশে, সর্বকালে, সর্বজীবে ধন্য। তিনি কোনো দলের নয়, কোনো সমাজের নয়, কোনো বিশেষ ধর্মের নয়, ব্রহ্মের অন্তর্নিহিত শ্রেষ্ঠ প্রকাশ মানুষে। বেদান্ত দর্শনে জীবকে ব্রহ্মস্বরূপ বলা হয়। ব্যবহারিকরূপে প্রতিভাত জীব ব্রহ্মের সাথে ভিন্ন এবং অভিন্ন দুই-ই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব প্রকৃতিকে অখণ্ড প্রাণশক্তির মূলাধার হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মায়াবাদ গ্রহণ না করে ঈশ্বরের দ্বারা যে জগৎ পরিব্যাপ্ত সে সর্বানুভূতিই সত্য বলে মনে করেন। বিশ্ব প্রকৃতির বিচিত্ররূপ সে চির সুন্দরেরই অঙ্গদ্যুতি। রবীন্দ্রনাথ তাই উপলব্ধি করেছেন, সৃষ্টির ধারার মধ্যে স্রষ্টার নিরন্তর লীলাবিলাস চলছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ তেমনি করে আমার হৃদয় ভিক্ষুরে, কেন দ্বারে তোমার নিত্য প্রসাদ পাওনা।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেদান্ত দর্শনের এক পর্যায়ে বলেছেন, উপনিষদ মানুষকে জীর্ণ বস্ত্র ও লোটাকম্বল নিয়ে সংসার ত্যাগী হতে অনুপ্রাণিত করেনি, এটা মানুষের প্রকৃত সত্তা উপলব্ধিতে সাহায্য করেছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বেদান্ত দর্শনের আধ্যাত্মিক অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদী। উপনিষদের ব্রহ্ম তাঁর সমগ্র জীবন সাধনায়, চিন্তায়, ধ্যানে, কবিতায়, গানে ধ্রুবতারার মতো পথ নির্দেশ করেছে। স্বর্গালোকের ব্রহ্মত্বের মহিমা তিনি মর্ত্যভূমির মানুষের মধ্যে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতোই রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছিলেন আমাদের অভাব কেবল সত্যের অভাব, আলোকের অভাব, অমৃতের অভাব, আমাদের জীবনের সকল দুঃখ পাপ নিরানন্দ কেবল এ জন্যই।