বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।

অথবা বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিস্তারিত বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
মানুষই তার পরিবেশ, প্রতিবেশ, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, নৈতিকতা সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রক। তার সৃষ্টি কর্মে অপ্রকৃতির কোনো স্থান নেই। অলৌকিকতার সবটা তার প্রজাতির নিজস্ব ও লোকায়ত এবং এটাই মানবতাবাদের মূলকথা। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসকে মানবতাবাদী দর্শনের জনক বলা হয়। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষই সবকিছুর মূল্যায়নের মাপকাঠি” (Man is the measure of all things)। আধুনিক যুগেও হবস, লক, রুশো প্রমুখ দার্শনিকও মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছেন। ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (স) মানবতার সপক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, “মানুষ একই আদমের সন্তান, মানুষ পরস্পর সমান, মানুষ পরস্পর ভাই, সাদা কালো, ধনী দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নাই।” চতুর্দশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর মাধ্যমে পাশ্চাত্য মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটে।
বাংলাদেশে মানবতাবাদ বা বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ : বাংলাদেশে মানবতাবাদী দর্শন একটি নতুন দিক। প্রাক ঐতিহাসিককাল পর্যন্ত এর উৎস এদেশে বিস্তৃত। প্রাক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন বাংলার লোকেরা ছিলেন জড়বাদী। জড়বাদী মানবতাবাদের প্রবক্তা হিসেবে এরা ছিলেন মানুষের ইহজাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যে বিশ্বাসী। তবে এদের এক অংশ ছিলেন অধ্যাত্মবাদী, এরা বাংলাদেশে ধর্মীয় মানবতাবাদের বীজ বপন করেন। বস্তুত প্ৰাক ঐতিহাসিককাল থেকেই বাংলাদেশে দু’ধরনের মানবতাবাদী চিন্তাধারা বিদ্যমান। একটি হলো সেক্যুলার মানবতাবাদ (Secular Humanism) ও অপরটি হলো নন সেক্যুলার মানবতাবাদ (Non-secular Humanism)। বাংলাদেশে মানবতাবাদের উদ্ভব ঘটে গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে। বলা চলে তিনি প্রথম মানবতাবাদ প্রচার করেন। তাঁর বিখ্যাত বাণী, “জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।” বাংলাদেশে মানবতাবাদ বিকাশে ইসলাম ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিন্দুরাও মানবতাবাদ প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ও বিবেকানন্দ অন্যতম। ইসলাম ধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম ছাড়াও কতকগুলো ধর্মীয় আন্দোলন যেমন- সুফিবাদ, বৈষ্ণববাদ ও বাউলবাদ বাংলাদেশে মানবতাবাদী চিন্তাধারার প্রকাশ ও বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য
কয়েকজন মানবতাবাদী দার্শনিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, গোবিন্দচন্দ্র দেব, শ্রীচৈতন্যদেব প্রমুখের
নাম স্মরণযোগ্য।
১. বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবতাবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, হিন্দু, মুসলিম, সুফিবাদী প্রভৃতি দার্শনিক মানবতাবাদের পত্র বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। এসব মনীষীরা মানবকল্যাণের জন্য তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন। আর তাই তাঁরা মরে গিয়েও বাংলার মানুষের কাছে আজও বেঁচে আছেন। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দর্শনে তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
২. বাউল মানবতাবাদ : বাংলাদেশ দর্শনের ইতিহাসে বাউল মানবতাবাদ একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এদের মধ্যে লালন শাহ ছিলেন সর্বাধিক পরিচিত। মরমি দার্শনিক লালন শাহ বলেছেন, জাহেরি আর নয়। লালন শাহ বিভিন্ন অঞ্চলে গান করে তাঁর মানবপ্রেম প্রচার করেছেন।
লালন শাহ বলেছেন,

এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না চিনিতে।”
বাউলরা মনে করেন, আত্মোপলব্ধির ফলেই পরমসত্তাকে পাওয়া যায়, অন্য পথে নয়। অনেকে মনে করেন, লালন শাহ মুসলিম মানবতাবাদী দার্শনিক। কিন্তু লালন শাহের গানে যে ভাবধারা দেখা যায় তা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের মতবাদ নয়, বরং তা বাংলাদেশী নিবিড় দর্শনাত্মক ও মনোবিজ্ঞানসম্মত সাধনার দান। বাউল দার্শনিকরা মানুষের জয়গান করতে গিয়ে ‘মানুষ ও মনুষ্যত্ব’ এর কথা বলেছেন, তেমনি অজানা মানুষ, অচিন মানুষ, গ্রেমের মানুষ, আলোর মানুষ, ভাবের মানুষ ইত্যাদির কথা বলেছেন। যেসব বাউল দার্শনিক মানবতার জয়গান করেছেন তাঁরা হলেন, লালন শাহ, দুমু শাহ, পান্থুশাহ, হাসন রাজা, সৈয়দ সুলতান, শেখ জাহিদ প্রমুখ।
৩. মুসলিম মানবতাবাগ : বাংলাদেশ দর্শনে অনেক মুসলমান মানবতাবাদের প্রচার ও প্রসার করেছেন। স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আব্দুল লতিফ, কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ফজলুল হক, মুজাফফর আহমদ, হযরত শাহজালাল, কাজী আব্দুল ওদুদ প্রমুখ বাংলাদেশী দার্শনিক মানবকল্যাণে মানুষের কথা বলেছেন। কাজী জল তাঁর গান ও কবিতায় মানবতার কথা বলেছেন।
নজরুল বলেছেন,
“জাগো নিপীড়িত, জাগো কৃষক
জাগো শ্রমিক, জাগো নারী।”
নজরুলের কাব্য ও সাহিত্য রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতির কল্যাণসাধন। তিনি মানুষের মুক্তি, শ্রমিক, কৃষক, সর্বহারা বা অন্ন, বজ্র, আশ্রয়, শিক্ষার অধিকারের জন্য বিদ্রোহ করেছেন। বাংলার মুসলিম দার্শনিকরা ইসলাম ধর্ম, ইসলামি দর্শন, ইসলামি সাহিত্য তথা মানবতাবাদী দর্শনের সাথে বাংলার জনগণকে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন দেখায় ও বাস্তবতায় বাংলার মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন।
৪. হিন্দু মানবতাবাদ: হিন্দু দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে মানবতাবাদের জোরালো প্রতিধ্বনি শোনা যায়,
“পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে যার
সেথা হতে সবে আনে উপহার
দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে-
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।”
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিপ্লবী মানবতাবাদ পশ্চিমবঙ্গের বর্ণবাদী হিন্দুসমাজে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ মানবকল্যাণে জাগ্রত সৈনিক। তিনি বলেছেন,
“জীবে প্রেম করে যেইজন
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
রাজা রামমোহন রায় মানবতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তা রহিত করেন। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা।’
যেসব হিন্দু দার্শনিক মানবতার জন্য সংগ্রাম করেছেন তাঁরা হলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পূর্ণচন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, গোবিন্দচন্দ্র দেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ দর্শনে যেসব দার্শনিক মানবতার জয়গান করেছেন তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেই মানবকল্যাণের পথ বেছে নিয়েছিলেন। এসব মনীষীরা মানবতাবাদের জয়গান যেভাবে গেয়েছেন তাতে তাঁরা বাংলার জনসাধারণের কাছে অমর হয়ে থাকবেন সারাজীবন। তাঁদের এ দৃষ্টান্ত গ্রহণ করলে বাংলার ঘরে ঘরে থাকবে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভালোবাসা। যদি এসব মনীষীর জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের জীবন, সংসার, সমাজ সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি, তবেই তাঁদের মানবতাবাদী আন্দোলন সার্থক হবে।