বাংলাদেশে অপরাধ দমনে সুশীল সমাজের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, অপরাধ প্রতিরোধে সুশীল সমাজের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, অপরাধ দমনে সুশীল সমাজের ভূমিকা বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে আলোচনা কর।
অথবা, “অপরাধ দমনে সুশীল সমাজ সম্ভাব্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে”-উক্তিটি ব্যাখ্যা
কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
প্রতিটি সমাজেই কোনো না কোনো নীতি বা মূল্যবোধ থাকে। সে কারণে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধারণা বিদ্যমান। এক সমাজে যা অপরাধ, অন্য সমাজে তা অপরাধ বলে বিবেচিত নাও হতে পারে। অপরাধমূলক আচরণ সবসময় আপেক্ষিক চূড়ান্ত নয়। যেমন- আমাদের সমাজে আজ থেকে ২০ থেকে ৩০ বছর পূর্বে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা গর্হিত ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজ তা সমাজের Rules ও Norms এর কিছুটা অন্তর্ভুক্ত হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশে অপরাধ দমনে সুশীল সমাজের ভূমিকা (Role of the Civil Society to suppress Crime in Bangladesh) : বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক অপরাধ সংঘটনে জড়িয়ে পড়ছে। সুশীল সমাজ তার নৈতিক শক্তির বিকাশের মাধ্যমে অপরাধ দমন করতে পারে। বাংলাদেশে অপরাধ দমনে সুশীল সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. প্রচলিত আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ : অপরাধ দমনে বাংলাদেশের সমাজে ফৌজদারি আইন প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ অপরাধ দমনে বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সমাজে অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যাবে। আর সুশীল সমাজ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে ।
২. আইনের অপপ্রয়োগ রোধ : দেশে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির পিছনে আইনের অপব্যবহার অনেকাংশেই দায়ী। আইনের অপব্যবহার রোধ ও সঠিক ব্যবহারের চর্চা করতে পারলে দেশে অপরাধ প্রবণতা অনেক কমে যাবে। আইনের অপপ্রয়োগ রোধ করে সুশীল সমাজ দেশের অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি : অপরাধ দমনের জন্য সামাজিক সচেতনতা থাকা প্রয়োজন। সরকারের একার পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয় না। সমাজের একটি প্রগতিশীল শাখা হিসেবে সুশীল সমাজের উপর একটি আলাদা প্রভাব আছে। ফলে তারা খুব সহজেই সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে।
৪. সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা : অপরাধ দমনে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। সুশীল সমাজ অপরাধ দমনের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে সজাগ করে তুলতে পারে। সরকারকে তাদের বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ প্রদান অপরাধ দমনের একটি সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৫. সামাজিক সমস্যার সমাধান : সুশীল সমাজ সমাজের প্রতিটি বিষয়ে সচেতন থাকে অর্থাৎ সমাজের সকল সমস্যা সম্পর্কে তারা অবহিত থাকে। যেহেতু সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা অপরাধের জন্ম দেয়, সেহেতু সামাজিক সমস্যার নিরসনের মাধ্যমে সুশীল সমাজ অপরাধ দমন করতে পারে।
৬. শিক্ষার প্রসার : শিক্ষিত মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা অনেক কম। তাই দেশে অধিক হারে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে দেশে অপরাধ প্রবণতা অনেক কমে যাবে। শিক্ষার প্রসার এবং শিক্ষাকে সহজলভ্য ও জীবনের উপযোগী করতে সুশীল সমাজ জাতীয় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে পারে।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা : বাংলাদেশের ন্যায় রাষ্ট্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সর্বদা বিরাজমান। এখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য মানুষ বিশৃঙ্খলায় মেতে উঠে। রাজনীতিকে ভর করে মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয় । সুশীল সমাজ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে অপরাধ দমন করতে পারে।
৮. প্রশাসনিক স্বচ্ছলতা আনয়ন : প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিদ্যমান দুর্নীতি, কর্তব্য পালনে অবহেলা ও পেশাদারিত্বের অভাবে দেশে অপরাধ বৃদ্ধি পায়। আর এজন্য প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রয়োজন। আর
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনতে সুশীল সমাজ গুরুত্বপ ূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৯. সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন : অপরাধ দমনে অপরাধী সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন হওয়া জরুরি। বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হলে অপরাধী আরো বেশি বিধ্বংসী হয়ে উঠে। তাই সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদনের মাধ্যমে অপরাধ দমনে সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
১০. সামাজিক মূল্যবোধ গঠন : বাংলাদেশে অপরাধ প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির মূল কারণ হলো সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধের অভাবে মানুষের মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এভাবে মানুষ যে কোনো অপরাধ কর্মের সাথে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। সুশীল সমাজ মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে পারে।
১১. অন্যায় অবিচার প্রতিহত করা : মানুষ অন্যায় ও অবিচারের মাধ্যমে অপরাধ করে। অন্যায় অবিচার থেকেই মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে আবার অপরাধ মানুষকে অন্যায় অবিচারের পথে ধাবিত করে। তাই সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলের জন্য সুশীল সমাজ অন্যায় অবিচার প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে।
১২. সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চা : বাংলাদেশের অপরাধ দমনে সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চার প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চায় পাশ্চাত্য ধারা অনুসৃত হয়। সমাজ সংস্কৃতির সুস্থধারার প্রসার ঘটাতে সুশীল সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
১৩. প্রচারণা ও সচেতনতা : সমাজের সহজসরল সাধারণ মানুষ সর্বদা অপরাধী কর্তৃক প্রতারিত হয়। সাধারণ মানুষের জ্ঞাতার্থে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হয়। ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতনতা দানের মাধ্যমে সমাজ থেকে অপরাধ দমন করা যায়।
১৪. দারিদ্র্য প্রশমন : বাংলাদেশের সমাজে দারিদ্র্যের প্রভাব প্রকট। দারিদ্র্যের কারণে অধিকাংশ মানুষ তাদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্ম করে থাকে। আর দারিদ্র্য প্রশমনে সুশীল সমাজ জাতীয় নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশে অপরাধ দমনের জন্য এখনও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠে নি। অপরাধ দমনের জন্য যে পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে, সেটা দুর্নীতি তথা অপরাধের শিকল ছিড়ে বেরিয়ে আসতে পারে নি। যে দেশ সারা বিশ্বে দুর্নীতিতে পরপর চারবার শীর্ষে অবস্থান করে সে দেশে সুশীল সমাজের বিকাশের পথ অনেকটা কণ্টকাকীর্ণ। তাই পুলিশ বাহিনী ও সুশীল সমাজ কোনটাই বাংলাদেশের সমাজ থেকে অপরাধ দমনে পুরোপুরি সফলতা প্রদান করতে পারছে না।