বাংলাদেশের মানুষের জীবনে লোকসংস্কৃতির যে চিত্র প্রতিফলিত হয় তা আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের মানুষের জীবনে লোকসংস্কৃতির চিত্র সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মানুষের জীবনে লোকসংস্কৃতির চিত্রের প্রতিফলন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের মানুষের সমাজ জীবনে লোকসংস্কৃতির প্রতিফলন সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য প্রিয় মানুষের প্রাণের কথা যে ভাষায় বলা সম্ভব লোকসংস্কৃতি তারই দাবিদার। বাংলার গ্রাম্য ঐতিহ্য বহনকারী এ লোকসংস্কৃতি আজও গ্রামাঞ্চলে, তাই প্রশংসনীয় হয়ে লোকের মুখে মুখে বিরাজ করছে। Folk culture is a life style which denotes rites and rituals, belives, norms and values. লোকসংস্কৃতি তাই বাঙালির জীবন প্রণালি বিশেষ করে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত জীবন প্রণালি বহন করে।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনে লোকসংস্কৃতিক চিত্র : এদেশের ৭৮% লোক গ্রামে বাস করে। কৃষির উপরই আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ভরশীল। এদেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতি হতে আলাদা হওয়ার কারণ হলো ভৌগোলিক দিক থেকে এদেশের মাটি উর্বর। বাংলাদেশের জমিতে প্রচুর ফসল ফলে। নদীতে মাছ জন্মে। পল্লিই হলো বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। লোকসংস্কৃতি তাই পল্লির ঐতিহ্য। পল্লিঅঞ্চলে অন্যান্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে অতি বিলম্বে। পল্লিবাসীরা নিজেদের বৈশিষ্ট্যগত চিত্রগুলো নিজেরাই প্রস্ফুটিত করেছে। গ্রাম বাংলার জীবন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির নমুনার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. বাসস্থানের নমুনা : আমাদের দেশের পল্লিতে প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বাঁশের তৈরি খড়ে ছাওয়া ঘরে বাস করে। বাঁশ ও উলুখড় আপনা থেকেই এদেশে প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। আবার অনেক উঁচু এলাকাতে মাটির ঘরও দেখা যায়। অবশ্য বেশিসংখ্যক গ্রাম বাংলাকে বাঁশের তৈরি বাড়িঘর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
২. লোককলা : শিল্পের দিক দিয়ে আমাদের গ্রাম্য সংস্কৃতির আলাদা একটা খ্যাতি রয়েছে। নকশিকাঁথা, বিভিন্ন বয়ন শিল্প, শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি তৈরি গ্রামীণ জনগণের জীবনের একটি বড় পেশা ছিল। সে সাথে গ্রামের মহিলাদের অবসর সময়কালীন কাজ ও বিনোদন, নকশিকাঁথা সেলাইয়ের সাথে সাথে গ্রাম্য বধুদের সুখ দুঃখের কল্পকাহিনী ও চয়ন একটা
অনবদ্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত । এছাড়াও গ্রাম বাংলায় মৃৎপাত্র, শীতল পাটি, বাঁশের খেলনা ও পাটের তৈরি শিকা প্রভৃতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ।
৩. খাদ্য : এদেশের লোকের প্রধান খাদ্য ভাত, মাছ, ডাল, মাংস ও তরিতরকারি। তাছাড়া পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানী ও নানারকমের পিঠা এদেশের লোক খেয়ে থাকে ।
৪. পোশাক পরিচ্ছদ : এদেশের গ্রামের মানুষের নিত্য ব্যবহার্য পোশাক হলো পুরুষের লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, শার্ট, চাদর ইত্যাদি। আর মেয়েদের শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোর্ট, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি। হিন্দুদের প্রধান পোশাক হলো ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর, লুঙ্গি ইত্যাদি। হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান সম্প্রদায় উভয়ের মেয়েদের পোশাক একই ।
৫. ধর্ম ও ধর্মীয় রীতিনীতি : আমাদের দেশে সাধারণত দু’টি ধর্মাবলম্বীর লোক রয়েছে; যথা : মুসলিম ও হিন্দু। মুসলমানগণ কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত পালন করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন- ঈদ, ঈদে মিলাদুন্নবী, ওরশ, শবে বরাত, শবে মেরাজ, শবে কদর ইত্যাদি। হিন্দুরা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, পূজা পার্বনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কার্যকলাপ গ্রামীণ জীবনে প্রভাব ফেলে। ধর্মীয় আচার বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তাদের জীবনযাত্রা পরিচালিত হয়। এছাড়া হিন্দুরা মূর্তিপূজা করে। তাদের জন্য আখড়া ও মন্দির রয়েছে। হিন্দুদের ধর্মরীতি অনুযায়ী জীবন প্রণালি পরিচালিত হয়।
৬. খেলাধুলা : গ্রাম বাংলার মানুষ তাদের অবসর জীবন কাটায় গানের আসরে ও নানা জাতীয় খেলাধুলার মাধ্যমে। যেমন- হাডুডু, কুস্তি, গ রুর লড়াই, লাঠিখেলা ইত্যাদি।
৭. লোকসংগীত : সাধারণ মানুষের জীবনে লোকসংস্কৃতির যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে তা হলো গ্রামের লোকসংগীত। গ্রামের মাঝিদের কণ্ঠে পল্লিগীতি ও ভাটিয়ালির সুর এক অনাবিল শান্তির আস্বাদন দেয়।
৮. আতিথেয়তা : বাঙালিদের মধ্যে সামাজিকতা রক্ষাকল্পে মেহমানদেরকে পান-তামাক ও শিরনী পরিবেশন করা হয়। গ্রামীণ বাঙালি সমাজে অতিথিপরায়ণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
৯. লোকজ চিকিৎসা : লোকসংস্কৃতির অন্যতম একটি দিক হলো লোকজ চিকিৎসা। এ চিকিৎসা সম্পূর্ণ গ্রামীণ জীবনে গ্রামীণ অভিজ্ঞ লোকদের দ্বারা গাছগাছালি থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন রোগের ঔষধ, যা অনেক সময় আধুনিক চিকিৎসাকেও হার মানায়। এসব লোকজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঝারফুঁক, পানিপরা এগুলো গ্রামীণ সহজসরল জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, লোকসংস্কৃতি হলো গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণের মাধ্যমে গড়ে উঠা এক নিজস্ব সংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যকে আমাদের সকলেরই বহন করা উচিত। কারণ, এর সাথে মিশে রয়েছে আমাদের নিজস্বতা ও স্বতন্ত্রতা। ঐতিহ্যময় বাঙালির সংস্কৃতিকে তাই লোকসংস্কৃতি বলা যায়। আমাদের লোকসংস্কৃতিকে আমাদেরই ক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, আমাদের নিজস্ব স্বদেশপ্রীতি।