দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারকগুলো বর্ণনা কর।

অথবা, দারিদ্র্যের সূচক বর্ণনা কর।
অথবা, দারিদ্র্যের মানদণ্ড আলোচনা কর।
অথবা, দারিদ্র্যের নির্ধারক বর্ণনা কর
অথবা, দারিদ্র্যের নির্ধারক সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
যদিও পঞ্চাশের দশক থেকে আমাদের দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন শুরু হয়েছিল, কিন্তু সমাজের অবহেলিত ও দুর্বল শ্রেণি এ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত রয়েছে এবং যত দিন যাচ্ছে ধনী ও গরিবের মধ্যকার এ ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সমসাময়িককালে দরিদ্রতা একটি বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে গেছে, যা মানবতার প্রতি একটি বড় অভিশাপ। আধুনিক মানবসভ্যতার বিকাশে দরিদ্রতা একটি মারাত্মক অন্তরায়। অনুন্নত ও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশের অনুন্নয়নের অন্যতম কারণ হলো দরিদ্রতা। দারিদ্র্যের সারিতে স্থান পাওয়া ১৩টি দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিশ্বে ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ (Poverty alleviation) একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে ।
দারিদ্র্যের সূচক বা নির্ধারক : উন্নয়ন যেমন একটি বহুমুখী ধারণা, তেমনি দারিদ্র্য একটি বহুমুখী সমস্যার সমন্বয়। তাই দারিদ্র্য চিহ্নিতকরণের কতকগুলো নির্দেশক আছে, যার ভিত্তিতে নির্ণয় করা যায় একটি দেশ দরিদ্র কিনা। নিম্নে এগুলো আলোচিত হলো :
১. স্বল্প মাথাপিছু আয় : স্বল্প মাথাপিছু আয় দারিদ্র্যের অন্যতম নির্দেশক। সাধারণত সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় ৩৬৫ ডলার, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। ফলে এ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। নিম্নে একটি তালিকার সাহায্যে দেখানো হলো : ৫৬% লোক
২. দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ (১,৪৭,৫৭০ বঃ কিঃ) কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধিজনিত কারণে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৭৫ (২০০১) জন। বাংলাদেশে বসবাসকারী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.৪৮%। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ দ্রুততা দেশকে আরও দরিদ্র করছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১৫০ কোটিতে । সুতরাং, এ লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি দরিদ্রতার একটি অন্যতম নির্দেশক।
৩. ভূমিহীনতা : আমাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু ভূমির পরিমাণ ০.১ একর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ দেশের মানুষকে ক্রমশ আরও ভূমিহীন করে তুলেছে। এর অন্যতম কারণ হলো দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। যে দেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা যত বেশি, সে দেশ তত দরিদ্র। নিম্নে কয়েকটি দেশের ভূমিহীনদের পরিসংখ্যান দেখানো হলো :

  1. শিক্ষা : বলা হয়, “Education is the key of all development.” সুতরাং, শিক্ষা একটা দেশের দারিদ্র্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম। এখানে ৭৫% পুরুষ এবং ৮৬% মহিলা নিরক্ষর। সুতরাং, উন্নয়ন এখানে অকল্পনীয় বলে মনে হয়। দারিদ্র্য এখানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে শিক্ষার অভাবে।
    ৫. বেকারত্ব : বিশ্ব ব্যাংকের জরিপের মতে, “এখানে প্রায় ৭৬% লোক বেকার । দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বল্প মাথাপিছু আয়, ভূমিহীনতা কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি মূলত বেকারত্বের কারণ যা দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক।”
    ৬. চিকিৎসা : অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এ ৩টি মৌলিক চাহিদার পর মানুষের দরকার চিকিৎসা সুবিধা। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে এ দেশের মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৩৬ টাকা, যা দ্বারা কোনো উন্নত চিকিৎসা আশা করা যায় না। তাছাড়া ৭৫% লোক অপুষ্টিতে ভোগে, ৩৫% লোকের বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা নেই ।
    ৭. প্রসূতি শিশু মৃত্যুর হার : তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অস্বাস্থ্য ইত্যাদি কারণে জনগণ স্বাস্থ্য সম্পর্কে অজ্ঞ, যার ফলে প্রতিনিয়ত মা ও শিশু মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে, যা দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক।
    ৮. সম্পদের অসম বণ্টন : স্বল্প সম্পদের অসম বণ্টন দারিদ্র্যের অন্যতম নির্ধারক। আমাদের দেশে এ চিত্র অতি ভয়াবহ। যেমন- মাত্র ২০ ভাগ লোক ৮০ ভাগ সম্পদ এবং ৮০ ভাগ লোক ২০ ভাগ সম্পদ ভোগ করে থাকে। এর ফলে ধনীরা আরও ধনী এবং গরিবরা ক্রমশ চরম গরিবের পর্যায়ে যায়।
    ৯. বাসস্থান : কৃষিনির্ভর জনগণ কৃষি ব্যবস্থাপনা বর্তমানে অলাভজনক হওয়ায় মানুষ শহরমুখী হয়। ফলে তারা ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, বস্তিতে ভারসাম্যহীনভাবে বসবাস করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, বাসস্থান সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করায় দারিদ্র্য আরও করাল গ্রাস ধারণ করে।
    ১০. পরিবেশগত সমস্যা : পরিবেশগতভাবে আমরা দারিদ্র্য। প্রকৃতিগতভাবে এ দেশের মানুষ অলস। অলসতা জাতিকে আরও দরিদ্র করে। পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, শীতপ্রধান দেশগুলো উন্নত, আর মৌসুমি জলবায়ুর দেশগুলো যেমন- বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ইত্যাদি দেশগুলো বেশি উন্নত হয়।
    এগুলো ছাড়া- ১. পুষ্টিহীনতা,
    ২. কৃষির উপর নির্ভরশীলতা,
    ৩. উচ্চ হারে মাইগ্রেশন প্রভৃতি দারিদ্র্যের সূচক হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে পরিশেষে বলা যায় যে, দারিদ্র্য উন্নয়নের জন্য একটি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এটা সার্বিক স্থিতিশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তবে এ দারিদ্র্যকে চিহ্নিত করার জন্য উল্লিখিত সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়। এ সূচকগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে এর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য কিছুটা দূর করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এর জন্য দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা একান্ত কাম্য। নতুবা দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব নয়। দারিদ্র্য দূরীকরণে মানবসম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এটা সম্পদ হিসেবে কাজ করবে। যেমন- ভারত তার বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে টিকে আছে, চীন তার জাতিসত্তাকে এখনও ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে বিশাল জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। সুতরাং, আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগই এ সমস্যা নিরূপণে সহায়তা করতে পারে বলে মনে হয়।