গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের প্রকৃতি বা স্বরূপ আলোচনা কর ।

অথবা, গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের প্রকৃতি আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের স্বরূপ আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বর্তমানে পৃথিবীতে এমন লোক যারা দৈনিক ১ ডলারের কম আয় করে তাদের মোট সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১২৮ কোটি। তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশই বাস করেন এশিয়াতে। আবার এশিয়ার ৯৫ কোটি দরিদ্র মানুষের ৫৩ শতাংশই (৫০ কোটি) বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এ ধরনের দরিদ্র জনগণ। বাংলাদেশে সমগ্র আশির দশকে দারিদ্র্যের হার ৫২.৩ (১৯৮৩-৮৪) শতাংশ থেকে ৪৯.৭ শতাংশের (১৯৯১-৯২) মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। বাংলাদেশের ৬ থেকে ৭ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ বাস করে গ্রাম এলাকায়। তাই গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের স্বরূপ আলোচনা করা বাঞ্ছনীয়। গ্রামীণ সমাজে দারিদ্র্যের প্রকৃতি (Nature of rural poverty) : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দরিদ্রতা চরম পর্যায়ে রয়েছে । গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের নিত্যদিনের মৌলিক চাহিদা শুধু খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা এবং বাসস্থানের মধ্যেই সীমিত নয়, এর সাথে যোগ হয়েছে তাদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি।যাই হোক, উল্লিখিত সংজ্ঞার আলোকে আমরা গ্রামীণ দারিদ্র্যের স্বরূপ নির্ণয়ের প্রয়াস পাই। গ্রামের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ সংকুলানের অভাবের প্রেক্ষিতে নিম্নে পর্যায়ক্রমে গ্রাম সমাজের দরিদ্রতার স্বরূপ বা প্রকৃতি তুলে ধরা হলো :
১. খাদ্য ও স্বাস্থ্য (Food and health) : পুষ্টির ঘাটতি গ্রামে প্রকট। গ্রাম এলাকার বিপুল জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মা এবং শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। অপুষ্টির শিকার প্রায় ৭০ ভাগ শিশু। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু খাদ্য ক্যালরি গ্রহণ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে সেখানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু পুষ্টি গ্রহণ ছিল ২০৯৪ ক্যালরি, ১৯৮২-৮৩ সালে তা কমে গিয়ে ১৯৪৩ ক্যালরিতে দাঁড়ায়। ১৯৮৩-৮৪ সালে গৃহস্থালি ব্যয়সংক্রান্ত জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে গড় দৈনিক খাদ্য ক্যালরি গ্রহণে অক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৪০ শতাংশ।
২. বজ্র (Cloth) : গ্রামের দরিদ্র জনগণ সেখানে প্রতিদিনের অন্নের সংস্থান করতে হিমশিম খায়, সেখানে তাদের জন্য দামি পোশাক আশাকের কল্পনাই করা যায় না। পুরনো ব্যবহৃত বা নোংরা জীর্ণ পোশাক পড়তে তারা বাধ্য হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল বিশেষত উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই শীতকালে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে প্রাণ হারায়। তাই গ্রামীণ দরিদ্রের স্বরূপ যে কতটা ভয়াবহ তা গ্রামাঞ্চলের মানুষের পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় বস্ত্র বা পোশাকপরিচ্ছদের অভাব থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে।
৩. বাসস্থান (Habitation) : গ্রামীণ এলাকায় বাড়িঘর তৈরির উপাদানের প্রাচুর্যের উপর বসতি স্থাপন বহুলাংশে নির্ভরশীল । বাসস্থানের জন্য বাঁশ, বেত, কাঠ, ছন ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। কিন্তু নির্মাণ সামগ্রীর সুলভ মূল্য বা সুলভ সরবরাহ না থাকায় গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়িই শ্রীহীন। সরকার গ্রামের বিপুল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আজ পর্যন্ত গৃহ বা বাসস্থানের কোনো সুবন্দোবস্ত করতে পারেনি। তাই গ্রামের প্রতিটি পরিবারের জন্য এক একটি পৃথক পৃথক স্থায়ী বাসগৃহের ব্যবস্থা করা বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। এছাড়া দরিদ্রতার কারণে গ্রামীণ পরিবারে আধুনিক জীবনের সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে।

  1. শিক্ষা (Education) : বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার (৭ বছর) ৫৬.৭%। গ্রামের ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী অধিকাংশ শিশু স্কুলে যায় না। এরা ক্ষেতখামারে তাদের অভিভাবকদের সাথে কাজ করে। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা ও নারী শিক্ষা প্রভৃতি শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও গ্রামীণ বৃহত্তর জনগণ এসব শিক্ষা সুবিধাবঞ্চিত এবং কিছু ক্ষেত্রে বিরত রয়েছে।
    ৫. চিকিৎসা সেবা (Medical services) : নানা প্রকার রোগব্যাধি গ্রামে অনেক বেশি। বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় প্রতি হাজারে ১১৮টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ডাক্তার নার্সের অভাবে, চিকিৎসা যন্ত্রপাতির স্বল্পতা, চিকিৎসার অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবে গ্রামের অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে আছে । অর্থাৎ, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষেরা আধুনিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত।
    ৬. সামাজিক নিরাপত্তা (Social security) : গ্রামের একেবারে অসহায় তালাকপ্রাপ্ত বিধবা, বৃদ্ধ, অক্ষম ইত্যাদি সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলোর জন্য বিশেষ সমস্যা হচ্ছে, সামাজিক বীমা বা সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। বাজারে, সমাজে, সংগঠনে তথা যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই দরিদ্ররা আত্মমর্যাদাসহ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত
    উপসংহার : সবশেষে বলা যায়, গ্রামীণ দারিদ্র্য চরম পর্যায়ে রয়েছে। কাজ করার জন্য সম্পদ দরকার। কিন্তু সে সম্পদের উপর দরিদ্রদের মালিকানা বা প্রবেশাধিকার সীমিত। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, বন্যা, অর্থনীতির মৌসুমি উঠানামা ইত্যাদির মুখে দরিদ্রদের টিকে থাকার ক্ষমতার অভাব রয়েছে। অধিকন্তু বেকারত্ব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার অভাব দরিদ্রতার রূপকে স্পষ্ট করে তুলছে। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন করা। কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি দিতে হবে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিতে মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন করা বাঞ্ছনীয়।