ড গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মানবতাবাদী মতবাদ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মানবতাবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবে গোবিন্দ চন্দ্র দেবের দার্শনিক মতের ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের দর্শনে তাঁর মানবতাবাদের স্থান নিরূপণ কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট মানবতাবাদী দার্শনিক, বাঙালি দর্শনের প্রাণপুরুষ,বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আজীবন সাধনায় লিপ্ত ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব দর্শনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম। দর্শনের তত্ত্বকে জীবনে প্রয়োগ করার ব্যাপারে তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। তাই তিনি বলেছেন, দর্শন মানেই জীবনদর্শন। আর যে দর্শনের সাথে জীবনের যোগ নেই তা নিছক তত্ত্বকথা; দর্শন হতে পারে না। আর এই দর্শনকে তিনি জীবনে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন সমগ্র মানবতার কল্যাণে।
মানবতাবাদ : যে মতবাদ মানবকল্যাণের কথা বলে তাই মানবতাবাদ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ কী করে বা কোন উপায়ে মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধিত হবে এসব বিষয় নিয়ে দর্শনের যে শাখা আলোচনা করে তাকে মানবতাবাদী দর্শন বলা হয়। দর্শনের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা মানবতাবাদী চিন্তাধারার পরিচয় পাই। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দর্শনের এদিকটির প্রতিই প্রায় সকল দার্শনিকের মনোযোগ আকর্ষিত হতে দেখছি। আমরা মানবতাবাদী দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর দুটি ধারা দেখতে পাই। যথা : ১. বস্তুবাদী ধারা এবং ২. আধ্যাত্মিক ধারা। প্রাচ্য দর্শনে আমরা এ দুটি ধারাই লক্ষ করে থাকি। মানবতাবাদের বস্তুবাদী ধারা আমরা লক্ষ করেছি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মানবতাবাদী দর্শনে। আর মানবতাবাদের আধ্যাত্মিক ধারা আমরা লক্ষ করেছি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের মানবতাবাদী দর্শনে। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব তাঁর মানবতাবাদী দর্শনে এ দুটি ধারার সমন্বয়সাধন করেছেন।
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মানবতাবাদ : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব সারাজীবনদর্শন চর্চা করেছেন মানবতার কল্যাণকে সামনে রেখে। মানবতার এই দার্শনিক মতের সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও। তিনি জীবনে কোনোদিন বিবাহ করেননি। তবে তিনি দু’জন দরিদ্র সন্তানকে মানুষ করেছেন, যাদের একজন হিন্দু এবং অপরজন মুসলমান। তারা দু’জনে আবার একজন নারী ও অন্যজন পুরুষ। তিনি তাঁর চাকরি জীবনের শেষের দিকে এসে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক তাঁর পালিত দুই সন্তানকে এবং বাকি অর্ধেক তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন, যার সবটুকুই ব্যবহৃত হচ্ছে মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে দর্শন চর্চায় ।
বস্তুগত মানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের মধ্যে সমন্বয় : ড. দেব বলেছেন, মানুষের পার্থিব বা জাগতিক উন্নতির জন্য বস্তুগত মানবতাবাদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা মানুষকে কখনো পরিপূর্ণ কল্যাণ বয়ে এনে দিতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এ প্রসঙ্গে ড. দেব বলেছেন, “মানবতাবাদ আমরা চাই এবং আমাদের কল্যাণের জন্যই আরো বেশি করে চাই। কিন্তু আমরা শুধু জাগতিক মানবতাবাদ চাই না, সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য জাগতিক মানবতাবাদ নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। কিন্তু তা একদেশদর্শিতায় দুষ্ট এবং আমরা যদি এই একদেশদর্শি ও চরমপন্থা মেনে নেই, তাহলে আমরা কুকুরের বাঁকা লেজ আর কখনও সোজা করতে পারব না।”
ড. দেব বলেছেন, মানবতার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে কখনই অবহেলা করা যাবে না। তিনি বলেছেন, যদি মানবতার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হয়, তবে সে মানবতাবাদ হবে রসহীন মানবতাবাদ, যা কাম্য নয়। তাই তিনি বলেছেন, বস্তুগত মানবতাবাদের সাথে আধ্যাত্মিক মানবতাবাদকে সমন্বয় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “একটি নতুন সমন্বয়ের প্রয়োজন, যে নতুন সমন্বয় বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগু লোর সমাহারে সমন্বয়ী বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে এবং এখানেই মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় জীবনদর্শন বিদ্যমান।
ড. দেবের মানবতাবাদী দর্শনে গৌতম বুদ্ধ ও স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব : ড. দেব তাঁর মানবতাবাদী দর্শন রচনায় প্রাচ্যের অপর দুই বিখ্যাত মানবতাবাদী দার্শনিক গৌতম বুদ্ধ এবং স্বামী বিবেকানন্দের মানবতাবাদী মত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ড. দেব স্বামী বিবেকানন্দের মানবতাবাদের প্রশংসা করে বলেছেন, “মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যক্তি মুক্তি অর্জনের প্রয়াসকে সঠিক পথে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা ছিল বিবেকানন্দের অপরিসীম প্রচেষ্টা। ব্যক্তি মুক্তি তথা সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য তাঁর বিশেষ গুরুত্বারোপ ব্যক্তির সর্বোচ্চ পূর্ণতা অর্জন এবং সাধারণ মানুষের চিরকালীন এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তা দূরীকরণের একটি সর্বোচ্চ প্রভাবজনিত প্রচেষ্টা।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব : ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব চেয়েছিলেন একটি শোষণ বঞ্চনাহীন বিশ্ব গড়ে তুলতে। তিনি দরিদ্র,অত্যাচারিত, নিপীড়িত দুঃস্থ মানুষকে শোষণ ও জুলুমের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি এমন এক মানবতাবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হবে প্রেম, সহানুভূতি এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সকল মানুষের হৃদয় মন জুড়ে থাকবে অনাবিল শান্তি। তিনি পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে এই ঐক্যের বাণী প্রচার করতে চেয়েছিলেন এবং গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। এ লক্ষ্যে তিনি ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে, তথা সর্বপ্রকার বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সকল মানুষকে একই মানবতার আদর্শে আনার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন সারাটি জীবন। তাঁর এই প্রচেষ্টার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের উইস বারে কলেজে প্রতিষ্ঠিত ‘The Govinda Dev, Foundation for World Brotherhood’ সংগঠনের মাধ্যমে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, ড. দেবের অন্যান্য দার্শনিক মতের মত তাঁর মানবতাবাদেও সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গির ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর মানবতাবাদী দর্শনে জাগতিকতাবাদ ও অধ্যাত্মবাদের এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধর্মীয় ও অধর্মীয় মানবতাবাদী চিন্তাধারার সমন্বয় করেছেন। সর্বোপরি, ড. দেবের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সকল মানুষকে এক ও অভিন্ন মানবতাবাদী আদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করা।