গ্রামীণ সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে যৌতুকের প্রভাব কতখানি আলোচনা কর।

অথবা, গ্রামীণ সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে কুপ্রথার প্রভাব কতখানি তা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজের বিবাহে যৌতুকের নেতিবাচক প্রভাবসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, গ্রামীণ সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে যৌতুকের প্রভাব বর্ণনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা :
যৌতুক একটি অসামাজিক ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুক এ মুহূর্তে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিও বটে। সমাজে বিশেষত গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যৌতুক দেওয়া নেওয়া কমছে না। বরং গ্রামাঞ্চলে যৌতুক ছাড়া কোন বিয়েই হয় না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যৌতুকের অর্থের পরিমাণ ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ
ছিল, যা গত ১০ বছরে ৫ হাজার থেকে ১ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, বিবাহের জন্য যৌতুক একটি আবশ্যিক বিষয় এবং বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে যৌতুক আদানপ্রদানের প্রবণতা অত্যধিক।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যৌতুকের প্রভাব (Impact of Dowry in the Rural Are as of Bangladesh) : বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। আর গ্রামীণ জনসাধারণ শিক্ষা ও সচেতনতার দিক থেকে শহরের মানুষের চেয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তাই সেখানে সামাজিক কুপ্রথা এবং এ প্রথার মারাত্মক প্রভাব উভয়ই শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অধিক বিদ্যমান। গ্রামীণ সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানে যৌতুকের প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন বলেছেন, “In rural Bangladesh the dowry tradition is an established practice among both Hindus & Muslims. Although the dowry has had a long tradition in Hindu marriages, Muslim marriages has too gradually institutionalize over the last few
generations.” অর্থাৎ, গ্রামীণ বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমান সমাজে যৌতুক প্রথা একটি প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন। যদিও হিন্দু বিবাহে যৌতুক প্রথা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। গত কয়েক প্রজন্মে মুসলিম বিবাহেও যৌতুক ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। যাহোক, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিবাহ ও যৌতুক পরস্পর সম্পর্কিত একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈবাহিক অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানে যৌতুক প্রথার (Dowry tradition) মারাত্মক প্রভাব । নিম্নে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো :
১. বিলম্ব বিবাহ : গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারগুলো কন্যার বিবাহের জন্য প্রয়োজনীয় যৌতুকের টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খায়। ফলে গ্রামের অনেক পরিবারের মেয়েরাই শহরে গার্মেন্টসে এসে কাজ করে। তারা নিজেদের বিবাহের যৌতুকের টাকা সঞ্চয় করতেথাকে। এতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিয়ের বয়স বেড়ে যায় এবং বিলম্ব বিবাহ (Late marriage) ঘটে ।
২. আর্থিক ধস : যৌতুকের মোটা অঙ্ক পরিশোধ করতে গিয়ে গ্রামের অনেক সচ্ছল পরিবারেও আর্থিক ধস নামে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কিছু কিছু পরিবার গৃহাঙ্গনের গাছপালা বিক্রি করে যৌতুকের টাকার ব্যবস্থা করেন।
৩. কন্যাপক্ষের ঋণগ্রস্ততা : সমাজের যে স্তরেরই হোক না কেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে বিয়েতে কমবেশি যৌতুক দিতেই হয়। ফলে দরিদ্র পিতা অনেক সময়ই গ্রামের ধনী বা মহাজনের নিকট থেকে অর্থঋণ সংগ্রহ করেন। আবার সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে তাকে বিপাকে পড়তে হয়।
৪. যৌতুকের লোভে বিবাহ : গ্রামের শুধু দরিদ্র পরিবারই নয়, অনেক নেতৃস্থানীয় ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের অভিভাবকেরা যৌতুক পাওয়ার লোভে তাদের ছেলে সন্তানের বিয়ে দিয়ে থাকেন বা বিয়ের সময় মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করেন। অধিকন্তু অর্থনৈতিক দৈন্যদশা ও বেকারত্বের কারণে গ্রামের শিক্ষিত ও বিবেকবান ছেলেরাও যৌতুকের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে চায় ।
৫. বিয়ে ভেঙে যাওয়া :বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যৌতুকের জন্য বিবাহ ভেঙে যাওয়ার অনেক ঘটনা ঘটছে। পাত্রপক্ষের দাবিকৃত টাকা, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী পরিশোধে ব্যর্থ হলে তারা বিয়ে ভেঙে দিতে পিছপা হয় না। অর্থাৎ দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলের বিবাহ অনুষ্ঠানে যৌতুক বা পণ অন্যতম প্রধান সমস্যা।
৬. ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার প্রবণতা : গ্রামীণ পরিবারের অনেক পিতামাতাই মনে করেন, তাদের মেয়ে সন্তানের বিয়েতে বড় অঙ্কের যৌতুক দিতে হয়েছে বা মেয়ে বিয়ে দিতে অনেক খরচ হয়েছে। তাই ছেলের বিয়েতে কন্যাপক্ষের নিকট থেকে মোটা দাগের যৌতুকের টাকা (Dowry money) এনে তাদের সে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিবেন। কারণ যৌতুক আদানপ্রদান আইনে নিষিদ্ধ হলেও কার্যত নিষিদ্ধ নয়। তাই মেয়ে বিয়ের ক্ষতি ছেলে সন্তানের বিয়ে দিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বিরাজ করছে, বিশেষত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে।
৭. তৃতীয় পক্ষকে যৌতুকে প্ররোচনা : বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজের বিবাহে পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষই যৌতুক নেওয়া ও দেওয়ায় স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে সম্মত থাকে। পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষের যৌতুক দেওয়া নেওয়ার সম্মতি বা ফলস্বরূপ একটি বিবাহ অনুষ্ ঠান সম্পাদিত হয়। যৌতুক আদানপ্রদানের কুপ্রভাব অনেকটা আবশ্যিকভাবে গিয়ে পড়ে তৃতীয়পক্ষের উপর। অর্থাৎ, তৃতীয়পক্ষ বিয়েতে যৌতুক আদানপ্রদানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্ররোচিত হয়। বিবাহে যৌতুকের প্রতি নৈতিক প্ররোচনা ঘটে (Moral instigation appears)।
৮. বাল্যবিবাহ ও ইলোপমেন্ট : গ্রামের দরিদ্র পিতামাতা কোন সুযোগ্য পাত্র পেলে তাদের কন্যাসন্তানের বয়স বিবেচনা না করেই বিয়ে দিতে উৎসাহী হন। কারণ ঐ পাত্র মেয়েকে যৌতুক ছাড়া বিয়ে করতে আগ্রহী থাকলে পাত্রীর পিতামাতা ঐ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। তারা জানেন, তাদের কন্যাকে পরবর্তীতে বিয়ে দিতে হলে যৌতুকের টাকা
সংগ্রহ করতে হবে। যৌতুক ছাড়া মেয়ের বিয়ে দেওয়া অসম্ভব। অন্যদিকে, গ্রামের অশিক্ষিত ও অবিবেচক অভিভাবক বিশেষত মাতা তার মেয়েকে প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন এমন ঘটনাও কম পাওয়া যায় না। এর নেপথ্য কারণ রয়েছে যৌতুক ছাড়া মেয়েটিকে বিদায় দেওয়া।
বৈবাহিক সম্বন্ধে উপরিল্লিখিত যৌতুকের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও বিবাহ পরবর্তী সময়ে যৌতুকের অন্যান্য প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। যেমন-
১. নারী নির্যাতন ও দাম্পত্য কলহ : বিয়ের সময় যৌতুকের দাবি পূরণ সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই পাত্রপক্ষ বিয়ের পরে অতিরিক্ত
যৌতুক দাবি করে । স্বামীর যৌতুকের দাবি মিটাতে না পারলে স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয় এবং দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়।
২. বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক : চাহিদাকৃত যৌতুকের টাকা না আনায় বাংলাদেশের বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলের নারীরা বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। যৌতুকলোভী স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে।
৩. আত্মহত্যা : যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার নারী স্বাভাবিকভাবেই আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয়। যৌতুকলোভী স্বামীরা এসব অসহায় নারীদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানে যৌতুকের আদানপ্রদান মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিরাজমান যৌতুক প্রবণতা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একক সমস্যা নয়, এটাকে গ্রামীণ সামাজিক সমস্যা (Rural Social Problem) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শুধু বিয়ে বা বিয়ের পূর্বেই নয়, বিয়ের পরেও যৌতুকের কারণে পরিবার ও সমাজে বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্বকলহের সৃষ্টি হয়। বউ পেটানো (Wife battering) থেকে শুরু করে এমনকি খুন, ধর্ষণ ও এসিড নিক্ষেপের মত জঘন্য ঘটনাও ঘটে।