অপরাধের ধরন সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, অপরাধের প্রকৃতি বা স্বরূপ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
অপরাধবিহীন সমাজ বাস্তবে প্রায় অসম্ভব। তবে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধারণা বিদ্যমান। এক সমাজে যা Crime অন্য সমাজে তা Crime বলে বিবেচিত নাও হতে পারে। অপরাধমূলক আচরণ সবসময় আপেক্ষিক, চূড়ান্ত নয়। যেমন- আমাদের সমাজে আজ থেকে ২০/৩০ বছর পূর্বে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা গর্হিত ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজ তা সমাজের Rules ও Norm এর কিছুটা অন্তর্ভুক্ত হয়ে এসেছে।
অপরাধের ধরন (Types of crime) : প্রযুক্তির অবদানে Crime এখন প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। যে কারণে গ্রাম, নগর, রাষ্ট্র বা মহাদেশ নয় বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন মাত্রা বা কারণে Crime এর ধরন ভিন্ন। এ প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. ব্রিটিশ আইনানুসারে মাত্রাভেদে অপরাধঃ
ক. লঘু অপরাধ : যা প্রধানত ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত।
খ. গুরুতর অপরাধ : যা প্রধানত সমাজকে প্রভাবিত করে
গ. রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ : যা রাষ্ট্রের আইনবিরোধী।
২. কারণভেদে অপরাধের ধরনঃ
ক. অর্থনৈতিক অপরাধ; খ. সামাজিক অপরাধ; গ. যৌন অপরাধ; ঘ. রাষ্ট্রীয় অপরাধ; ঙ. মনস্তাত্ত্বিক অপরাধ ।
৩. ধরনভেদে অপরাধ ঃ
ক. গতানুগতিক অপরাধ; খ. সংঘটিত অপরাধ; গ. রাজনৈতিক অপরাধ; ঘ. ভদ্রবেশী অপরাধ। তবে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন অপরাধ মূলত উপরের তিন শ্রেণীতেই বিভক্ত। যথা :
ক. ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ (Crimes against persons) : ব্যক্তিবিশেষ বা ব্যক্তিসমষ্টির বিরুদ্ধে সরাসরি যে Crime সংঘটিত হয়, তাই Crimes against persons বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। এ ধরনের Crime কে জনগণ সবচেয়ে বেশি ভয় করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাধারণত দৃষ্টির অন্তরালে, সন্ধ্যার পর
অন্ধকারে এবং নির্জন পরিবেশে এ ধরনের Crime ঘটে থাকে। বস্তুত এ ধরনের Crime অন্যান্য অপরাধের মত ক Common নয়। FBI এর Report মতে, Persons এর বিরুদ্ধে যত Crime সংঘটিত হয় তার ১০% Murder, robbery, rape ইত্যাদি।
খ. সম্পদের বিরুদ্ধে অপরাধ (Crimes against property) : সাধারণত যেসব অপরাধ সম্পদ বা সম্পত্তির সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো হলো Crimes against property. ব্যাংক ডাকাতি, স্বর্ণালংকার চুরি, গাড়ি চুরি, মোবাইল ছিনতাই ইত্যাদি এ ধরনের অপরাধের উদাহরণ। মূলত অর্থকে কেন্দ্র করেই মানুষ বেশি অপরাধী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের সুযোগ বেশি বলে এ ধরনের Crimeও বেশি। FBI এর তথ্যানুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত গাড়ি চুরি হয় তার অধিকাংশই ঘটে মালিকের দায়িত্বহীনতার কারণে। কেননা তারা গাড়িতে চাবি রেখে যায়
গ. নৈতিকতা বিরোধী অপরাধ (Crimes against morality) : যেসব অপরাধ ব্যক্তি বা সমষ্টির নৈতিকতাকে নিয়ে আবর্তিত তাই Crimes against morality. এ ধরনের Crime হচ্ছে Criminal law এর সবচেয়ে বিতর্কিত মাদকাসক্তি ইত্যাদি এ Crime এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের Crime ব্যক্তি স্বেচ্ছায় করে এবং ব্যক্তির ইচ্ছাই কার্যকর হয়
তবুও Crime সম্পাদনে সহযোগীরাও এ ধরনের Criminal হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ ধরনের Criminal activities যা সমাজকে বা সমাজের Norms কে Violate করে তা Crime হিসেবে গণ্য। উপর্যুক্ত তিন প্রকারের Crime এর ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের Crime বর্ণনা করা যায়। যথা :
i. পেশাগত অপরাধ (Professional crime) : মানুষ যখন কোন অপরাধমূলক কাজকে তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন বা পেশা হিসেবে নেয় তখন তাকে Professional crime বলে। পেশাগত অপরাধীরা অপরাধকে পেশা হিসেবে এমনভাবে গ্রহণ করে যে, তারা কখনও অপরাধ সংশোধন করতেও এ থেকে বের হয়ে আসতে চায় না। শুধু তাই নয়, নিজেরা অপরাধ করার পাশাপাশি অন্যকেও উৎসাহিত করে। এভাবে তারা নতুন অপরাধী তৈরির মাধ্যমে একটি সু-সংঘটিত অপরাধ চক্র গড়ে তোলে। থিকে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিঁধেল চুরি, ঘর চুরি, দোকান চুরি, হাইজ্যাকিং, পকেট মারা ইত্যাদি ।
ii. প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ (Organized crime) : কোন প্রতিষ্ঠিত, শক্তিশালী সংগঠনে র উদ্যোগে ও পরিচালনায় ‘গ্যাংগ’ ভিত্তিক যে Crime হয়ে থাকে তাকে বলা হয় Organized crime. এগুলো হলো পাচার, চোরাচালান, জুয়া, পতিতাবৃত্তি, মাদক ব্যবসায় ইত্যাদি, এগুলো দলীয়ভাবে সংঘটিত হয়। এ ধরনের অপরাধের যারা নেতৃত্ব দেন তাদেরকে বিগবস বা গডফাদার করা হয়। এ বিগবসদের বেশকিছু সহকারীর সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রকারের Organized crime ঘটে থাকে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ জাতীয় Crime এর ক্ষেত্রে Mafia, Mob, Laeosa, Nastra ইত্যাদি চক্রগুলো প্রসিদ্ধ। পৃথিবীতে এ অপরাধগুলো সবচেয়ে ভয়াবহ আর এর স্বার্থে আন্তর্জাতিক চক্রের বিভিন্ন রাঘব বোয়াল জড়িত থাকে বলে তা নির্মূল বা প্রতিরোধ করা দুরূহ।
iii. ভদ্রবেশী অপরাধ (Whitecollar crime) : সাদারল্যান্ড Whitecollar crime সম্পর্কে বলেছেন, “Whitecollar crime is a violation at criminal law by the person of upper social, economic class, in the course of his occupational activities.” তাঁর মতে, এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে, বিশ্বাস ভঙ্গ, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কর্পোরেশনের বিবৃতিতে মিথ্যা তথ্য প্রচার, অপরের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করা, Trade mark নকল করা, জাল টাকা বের করা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ইত্যাদি। Herbert Edelhertz এ ধরনের অপরাধের উদাহরণে সাদারল্যান্ড এর চেয়ে ভিন্ন চিত্র দেখিয়েছেন। যেমন— মিথ্যা আয়কর, বিবৃতি দান, সামরিক নিরাপত্তা ভাতার জন্য মিথ্যা দাবি, টাকা জমা না রেখে Credit card দেখিয়ে লেনদেন করা ইত্যাদি। সাদারল্যান্ড অধুনা এক ধরনের Technological crime এর কথা বলেছেন, যাকে বলা হয় Computer crime. এ ধরনের Crime এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ১৯৯০ সালের হিসাব মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৩-৫ বিলিয়ন ডলার Computer crime এর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, American former president নিক্সনের ‘Watergate’ কেলেঙ্কারীর কথা বলা যেতে পারে ।
iv. রাজনৈতিক অপরাধ (Political crime) : বর্তমানে এককথায় বলা হয়, রাজনীতি মানে মিথ্যানীতি, সকল অপকর্মের মূল। রাজনীতির ছত্রছায়ায় যেসব Crime সংঘটিত হয় তাকে Political crime বলে। নিম্নে রাজনৈতিক অপরাধের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :

  1. Anti political party এর নেতা কর্মীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা।
    ২. প্রতিপক্ষের অফিস, বাসস্থান এবং মিছিলে হামলা করা।
    ৩. প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে দলীয়করণ ও আত্তীয়করণ।
    ৪. সেনাবিদ্রোহ উস্কানি দেয়া।
    ৫. সন্ত্রাসী মদদ দানের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যার পরিকল্পনা ইত্যাদি ।
    v. যৌথ মালিকানা বিষয়ক অপরাধ (Corporate crime) : যৌথ মালিকানা বিষয়ক কাজকর্মে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে
    ব্যক্তিবিশেষ বা সম্মিলিতভাবে যে অপরাধ করে তা হলো Corporate crime। যেমন- শেয়ারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কেউ তা আত্মসাৎ করা।
    vi. কিশোর অপরাধ (Juvenile delinquency) : অল্পবয়স্ক বা তরুণ ছেলেমেয়েরা সাম্প্রতিক বিশ্বে বিচিত্র অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তা হলো Juvenile delinquency। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এ অপরাধ প্রচুর। যেমন- সাম্প্রতিক আমেরিকার এক স্কুলে মর্মান্তিকভাবে ২৫ জন ছাত্রীর হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ২ জন কিশোর।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, অপরাধ হলো একটি সামাজিক ব্যাধি। এ অপরাধকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে সমাজের সার্বিক দৃষ্টিতে যা ঘৃণাত্মক তাই অপরাধ। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধকে ব্যাখ্যা করেছেন। অতএব সামাজিক মূল্যবোধহীন কাজই অপরাধ।