অথবা, রবীন্দ্র চেতনায় মানবধর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রবীস্থা চেতনায় মানবধর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্র চেতনায় মানবধর্ম সংক্ষেপে তুলে ধর।
উত্তর।। ভূমিকা : বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবতার জয়গান নিয়ে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাঙালি জাতির গর্ষ, বাংলা সাহিত্যের কর্ণধার। তাঁকে আকাশের সাথে তুলনা করা যায়। তিনি বাংলাদেশ দর্শনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন মানবপ্রেমিক, মানব সেবক। তাই তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন গতি থেকে মুক্ত সমুদ্রে। ধর্ম নিয়ে তিনি বলেছেন, ধর্ম মানে মানুষের ধর্ম।
রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম: নিম্নে তাঁর মানবধর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো।
১. উপনিষদের চিন্তা : উপনিষদে হিন্দুধর্মীয় মানবতাবাদের বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সেখানে উপনিষদের আদর্শ বিশেষভাবে মেনে চলার চেষ্টা করা হতো। উপনিষদের এ মানবতাবাদী আদর্শ রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আছে। এছাড়াও হিন্দুধর্মের অন্যান্য আদর্শিক মতবাদও তাঁর মানবতাবাদী চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল।
২. কুসংস্কারমুক্ত : রবীন্দ্রনাথের সময় হিন্দুধর্ম জাতিভেদ, মূর্তিপূজা ইত্যাদি নানা কুসংস্কারের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। দেশ ও জাতিকে এ ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করার জন্য ১৮২৮ সালে রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজ। পরবর্তীতে এ পরিবেশে ব্রাহ্মধর্মের মূল লক্ষ্য সত্য, শিব ও আনন্দময় সত্তা এক ও অদ্বিতীয় পরমাত্মাকে জীবনে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেন রবীন্দ্রনাথ।
৩. অত জীবনবোধ : সমগ্র মানবজীবন সম্বন্ধে এক অখও অনুভূতি তাঁর দৃষ্টিকে সমস্বয়মুখী করে তুলেছিল। বেদ,বেদান্ত, উপনিষদ, ইসলাম ও ব্রাহ্মধর্মের অদ্বৈতবাদী চিন্তাধারার সাথে বাউল, কবি, বৈষ্ণব, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধধর্মের ভক্তি, প্রেম ও ত্যাগের মহাসমন্বয়ে তিনি গড়ে তুললেন এক অখও জীবনবোধ। এ জীবনবোধই রবীন্দ্রনাথের সত্য চেতনা। মানুষের মাঝেই এ চেতনার পরিপূর্ণ প্রকাশ।
৪. মানুষের মাঝে বিশ্বমানবিকতা : মানুষের মাঝে বিশ্বমানবতার অবস্থান বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন। তাঁর মতে, মানুষের অন্তর চেতনায় এ অনুভূতি বিকশিত হয়ে উঠে। মানব ধর্মের এ প্রয়োজনবোধ মানুষের অন্তরে মনুষ্য প্রকৃতিতেই লুকিয়ে আছে। খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় সংগ্রহের নিত্য তাগিদের আরও গভীরে এ ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করে মানুষ।
৫. মানবজীবনে প্রয়োজনবোধ : রবীন্দ্রনাথের মতে, মানবজীবনে প্রয়োজনবোধ দুটি। একটি বস্তু জগতের এবং অন্যটি অন্তর জগতের। তাঁর মতে, এ অন্তর জগতেই জেগে উঠে বিশ্বমানবের সাথে মিলিত হওয়ার এক মহান আকুতি।
৬. বিশ্বমানবের সাথে মহামিলন : রবীন্দ্রনাথের মতে, আমাদের জন্মভূমি তিনটি। পৃথিবী, স্মৃতিলোক এবং আর্থিক লোক। তাঁর মতে, মানবজীবনের এ তিন বাসস্থান পরস্পর জড়িত। তাই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কও অতি ঘনিষ্ঠ। ব্যক্তিমানুষ তার অন্তর চেতনার বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বমানবতার সাথে মিলিত হয়ে পড়ে। বিশ্বমানবের সাথে মহামিলনের মধ্যেই মনুষ্য প্রকৃতির পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে।
৭. প্রেম ও কল্যাণকর কর্মই মানবধর্ম : রবীন্দ্রনাথ ধর্মাচরণের সকল বৈপরীত্যকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে প্রেম ও কল্যাণকর কর্মকেই মানবধর্মের মূল আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে, যে মানুষের মাঝে বিশ্বমানব ঈশ্বরের প্রকাশ সে মানুষের সেবা ও ভালোবাসাই শ্রেষ্ঠ ধর্মাচরণ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রবীন
্দ্রনাথ মানুষের ধর্মবোধ ও নীতিবোধের মধ্যে এক সুন্দর সমন্বয়সাধন করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থ ও গণস্বার্থের সংঘাতই নৈতিক জীবনের মূল সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ মানবধর্ম আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করেছেন। তাঁর মতে, বিশ্বজনীন স্বার্থে আত্মনিয়োগ করে মানুষ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র মানবসমাজের মহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে।