অথবা, তুমি কিভাবে অপরাধ ও বিচ্যুতির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করবে? আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের জীবন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ফলে অপরাধ ও বিচ্যুতিমূলক আচরণের পরিবর্তনের সাথে সাথে এর প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচ্যুতি ও অপরাধ সংক্রান্ত আলোচনা এখন সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম আলোচিত বিষয়। বিচ্যুতি ও অপরাধের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সামাজিক বিজ্ঞানের
নতুন একটি শাখা, যার নাম অপরাধবিজ্ঞান। অপরাধবিজ্ঞানের সাথে বিচ্যুতি ও অপরাধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত সমাজে সংগঠিত বিচ্যুতি বা অপরাধমূলক আচরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অনুশীলনই হচ্ছে অপরাধবিজ্ঞান। বলা যায় যে, বিচ্যুতি ও অপরাধ সংক্রান্ত সমাজবিজ্ঞানের অপর নামই হচ্ছে অপরাধবিজ্ঞান।
অপরাধ ও বিচ্যুতির পার্থক্য : সমাজের প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে যে আচরণ করা হয় তাই হচ্ছে বিচ্যুতি, যার চূড়ান্ত রূপ হলো অপরাধ। বিচ্যুতি বা Deviance এবং অপরাধ বা Crime একই বিষয় মনে হলেও এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বিচ্যুতি ও অপরাধের পার্থক্য আলোচনা করা হলো :
প্রথমত, বিচ্যুতি বা Deviance ও অপরাধ বা Crime অনেকটা একই রকম মনে হলেও সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীদের বর্ণনা মতে এদের সংজ্ঞাগত পার্থক্য স্পষ্ট। আর. টি. শেফার এবং আর পি. লাম বলেছেন, “Deviance is behaviour that violates the standards of conduct or expectations of a group or society.” অপরদিকে, অপরাধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আর. টি. শেফার এবং আর পি. লাম বলেছেন, “Crime is a violation of criminal law for which formal penalties are applied by some governmental authority.”
দ্বিতীয়ত, বিচ্যুতি হলো কোন নির্দিষ্ট সমাজের প্রচলিত রীতিনীতিগুলো ভঙ্গ করা। অপরদিকে, দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে উল্লিখিত সব ধরনের কার্যক্রমই অপরাধ বলে গণ্য ।
তৃতীয়ত, Deviance হলো Social Norms ও Folkways এর বিরুদ্ধে কোন আচরণ। অন্যদিকে, Crime হলো Social Norms এর বিরুদ্ধে কোন কাজ।
চতুর্থত, Deviance এর জন্য আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু Crime এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তি নির্ধারিত। Schaefer & Hamm বলেছেন, “It represents some type of devitions from formal social norms administrated by the state.”
পঞ্চমত, Deviance হলো Crime এর পূর্বাবস্থা আর Crime হলো Deviance এর চূড়ান্ত পর্যায়। Brown and Seleznick, “Crime is properly understood as part of the boarder phenomenon of deviance.”
ষষ্ঠত, বিচ্যুতিটা কখনই অপরাধ নয়। কিন্তু অপরাধ হচ্ছে এক প্রকার Deviance বা বিচ্যুতি।
সপ্তমত, Deviance অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়। কিন্তু Crime, deviance অপেক্ষা বড় বিষয়।
অষ্টমত, Deviance সংক্রান্ত আলোচনায় Folkways সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে হবে। Folkways হলো এমন আইনকানুন, যা পালন না করলে শাস্তি দেয়া হয় না। অর্থাৎ যা বাধ্যতামূলক নয়। Folkways হচ্ছে গতানুগতিক জীবনধারা, যার উদ্দেশ্য হলো একটি বিশেষ ছাঁচের মধ্যে ফেলে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তোলা। অপরদিকে, Mores হলো এমন
আইনকানুন, যা পালন না করলে শাস্তি দেয়া হয়। অর্থাৎ এটা বাধ্যতামূলক।
নবম, Deviance বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একক বা ব্যক্তিগত আচরণ, কিন্তু Crime ব্যক্তিগত ছাড়াও সমষ্টিগত আচরণ। এভাবে দেখা যায় যে, Deviance ও Crime এর মধ্যে একটা নিগূঢ় সম্পর্ক বিদ্যমান। সেজন্য অনেক সমাজবিজ্ঞানী Crime অর্থে Deviance বা Deviant অর্থে Criminal শব্দ ব্যবহার করেছেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং অন্যান্য মানব আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিচ্যুতি ও অপরাধ পেয়েছে নতুন মাত্রা ফলে অপরাধবিজ্ঞানের ধ্যানধারণায়ও পরিবর্তন এসেছে। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার পাশাপাশি নীতিবোধ ঠিক থাকলেই অপরাধ ও বিচ্যুতিমূলক আচরণ হতে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব।