ডুরখেইম এবং রবার্ট কে. মার্টনের বিচ্যুতি ও অপরাধ সংক্রান্ত মতবাদ দু’টি আলোচনা কর।

অথবা, বিচ্যুতি ও অপরাধ সম্পর্কে ডুরখেইম ও রবার্ট কে. মার্টন যে মতামত দিয়েছেন তা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বিচ্যুতি ও অপরাধ সংক্রান্ত ডুরখেইম ও রবার্ট কে. মার্টন যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তা তুলে ধর। অথবা, বিচ্যুতি ও অপরাধ সম্পর্কে ডুরখেইম ও রবার্ট কে. মার্টন কিভাবে আলোচনা করেছেন? বিস্তারিত তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ সবসময় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না এটাই স্বাভাবিক। আর এ সমন্বয়হীনতা থেকে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তার ফলেই মানুষ সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি অমান্য করার বা সমাজের আদর্শ ও মূল্যবোধ পরিপন্থী কাজ করতে উৎসাহিত হয়। এ প্রচলিত রীতি বিরোধী ও সামাজিক প্রথার পরিপন্থী কর্মকাণ্ড বা আচরণকেই Deviance বা বিচ্যুতি বলে। এ বিচ্যুতির চূড়ান্ত রূপই হলো Crime বা অপরাধ, যা করলে আইন অনুসারে শাস্তি ভোগ করতে হয়।
এমিল ডুরখেইমের তত্ত্ব : বিচ্যুতিমূলক আচরণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় Emile Durkheim এর Anomic theory এর মাধ্যমে। Emile Durkheim বিচ্যুতিমূলক আচরণের জন্য Anomic কে দায়ী করেন। তাঁর ভাষায়, “Anomic is a state of normlessness which typically occurs during a period of profound social change and disorder, such as a time of economic collapse.”
ডুরখেইমের তাঁর ‘The Division of Labour in Society’ গ্রন্থে যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে। তিনি আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে অপরাধমূলক আচরণ ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন। সমাজবিজ্ঞানের প্রথম অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানভিত্তিক গ্রন্থ ‘Suicide’ এ তিনি তাঁর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। Durkheim এর মতে, “সামাজিক রীতিনীতি দ্বারা ব্যক্তি
সমাজের প্রতি তার প্রত্যাশা বা তার প্রতি সমাজের প্রত্যাশা জানতে পারে। আর যখনই ব্যক্তি সমাজের কাছে তার চাহিদা পূরণে তৎপর হয় তখন বিভিন্ন শ্রেণীমুখী স্বার্থ ও সামাজিক অসঙ্গতির ফলে অর্থাৎ Anomic এর কারণে সে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে ব্যক্তি এ Norms বা Values অবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ক্রমান্বয়ে ডেভিয়ান্ত হয়ে যায়।”
Emile Durkheim এর পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, প্রধান তিনটি কারণে মানুষ Anomic deviance আচরণ করে । যথা :
১. ব্যক্তিগত সামাজিক আদর্শ খর্ব করা (Failed to internalize the norms of society),
২. আদর্শ পরিবর্তনে সমাজের সাথে মিলতে অক্ষম (Unable to adjust with changing norms) এবং
৩. সামাজিক আদর্শের সাথে বিরোধিতা (Conflict with the norms of society)।
Durkheim অপরাধ সংক্রান্ত আলোচনায় আত্মহত্যা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি Suicides এর অন্যান্য কারণের চেয়ে সামাজিক কারণের উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি আত্মহত্যার শ্রেণীবিভাগ করতে গিয়ে Egoistic suicide এবং Altruistic suicide এর পাশাপাশি Anomic suicide এর কথা উল্লেখ করেন।
Anomic suicide : এ ধরনের আত্মহত্যার সাথে Durkheim এর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ‘State of normlessness’ এর ক্ষেত্রে মানুষের আদর্শের মূল্যবোধ নেই, তার কাছে সবকিছুই অর্থহীন। বিশেষ করে সামাজিক পরিবর্তনের ক্রান্তিলগ্নে এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে। এখানে ব্যক্তিসত্তার হত্যা হচ্ছে না এ মানসিকতা থেকে সে নানা ধরনের অপরাধ করতে পারে। কারণ তার কাছে সব অপরাধই বৈধ মনে হয়। সে এক্ষেত্রে আত্মহত্যার পরিবর্তে পর হত্যা করে। একটা মানসিকতা আসে যখন ন্যায় অন্যায় বোধ থাকে না। যখন সে নিজের জীবনকে অর্থহীন ভাবে তখন সে অন্যের জীবনকেও অর্থহীন ভাবে। এই যে বিশেষ মানসিকতা তাকেই Durkheim Anomic বলেছেন। এ Anomic suicide সামাজিক ক্রান্তিলগ্নে ব্যাধির মত দেখা দেয়। এভাবে মানুষ Anomic suicide করে সামাজিক বিচ্যুতি বৃদ্ধি করে। অপরাধমূলক আচরণ ব্যাখ্যায় Durkheim এর মতামত গ্রহণযোগ্য। তাই বলা যায়, Deviance এবং Crime এর ক্ষেত্রে Durkheim এর তত্ত্বটি পুরাতন হলেও আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
রবার্ট কে. মার্টনের তত্ত্ব : প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী R. K. Merton বিচ্যুতির কারণ হিসেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে দায়ী করেন। তিনি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘Social Theory of Social Structure’ এ Different types of adaptative এর উল্লেখ কর ে তাঁর তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি মনে করেন, বিচ্যুতি বা Deviance হলো নৈরাজ্যজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে জনগণের Response ও Adaptation এর একটি স্বরূপ। তাঁর মতে, সামাজিক কোন Goals পূরণে।. সমাজস্বীকৃত পন্থার বিপরীত কোন পথ অবলম্বন করার ফলে Deviance এর উদ্ভব ঘটে। Merton বিচ্যুতিমূলক আচরণকে পরীক্ষা করতে গিয়ে সেটিকে Social malintegration এর ফলাফল হিসেবে দেখিয়েছেন এবং বিভিন্ন ধরনের বিচ্যুতির সাথে Malintegration এর প্রকৃতি বিশেষভাবে জড়িত বলে বর্ণনা করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি বিচ্যুতির সাথে Anomic এর আলোচনা করেন। Merton বিচ্যুতির সাথে Anomic এর Adaptation এর সম্পর্ক নির্দেশ করতে গিয়ে দুটি Concept ব্যবহার করেন । যথা :
১. সাংস্কৃতিক লক্ষ্য (Cultural goals) এবং
২. প্রাতিষ্ঠানিক উপায় (Institutionalized means)। Merton এর মতে, “সমাজে Institutionalized means সকলে সমভাবে লাভ করতে পারে না। আর তাই Goals এবং Means এর মধ্যে সামঞ্জস্যতার অভাব দেখা যায়। ফলে ব্যক্তির Social adaptation এর মধ্যেও বিভিন্ন Mode দেখা যায়। এ প্রেক্ষিতে Schaefer এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “Consequently, he developed the anomic theory of deviance which posits five basic forms of adaptation.”
সমাজের সাথে খাপখাইয়ে চলার জন্য একজন ব্যক্তি কি আচরণ করে সেটা Merton নিম্নের ছকের মাধ্যমে দেখিয়েছেন ঃ
Mode of adaptation Institutionalized means. Cultural goals Conformity Innovation. Ritualism Retreatism.
Rebellio [ Source : R. K. Merton, Social Theory and Social Structure, 1968; P-194]
প্রচলিত সাংস্কৃতিক নিয়ম মেনে চললে সেটা হবে (+) আর এর বিপরীত ঘটলে সেটা হবে (-)। ব্যাখ্যা : এ ছকে দেখা যায় যে, প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তি Goals এবং Means উভয়টিকে সমর্থন করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে Goals কে সমর্থন করে, কিন্তু Means কে সমর্থন করে না। তৃতীয় পর্যায়ে Goals কে সমর্থন করে না, কিন্তু Means কে সমর্থন করে। চতুর্থ পর্যায়ে Goals এবং Means কোনটিকেই গ্রহণ করে না। শেষ পর্যায়ে নিজেরাই নতুন Goals এবং Means আবিষ্কার করে
Examples : Merton এর তত্ত্বানুসারে বিচ্যুতিমূলক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উদাহরণসমূহ প্রযোজ্য :
i. Conformity – The opposite persons of deviants,
ii. Innovation – Occupational thief,
iii. Ritualism- Bureaucratics,
iv. Retreatism – Hippi,
v. Rebellion – The opposite of the above patterns.
বিচ্যুতিমূলক আচরণ ব্যাখ্যায় R. K. Merton এর তত্ত্বটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর Merton এর তত্ত্ব থেকে সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে, “Therefore, deviance can be understood as socially created behaviour, rather than as the result of momentary pathological impulses.” [R.T. Schaefer-Sociology, 1995; P-184]
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বিচ্যুতি ও অপরাধ সম্পর্কে Durkheim এবং Robert K. Merton যে মতামত দিয়েছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মানুষ কোন
পরিস্থিতিতে কিভাবে অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে এবং কেন সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তার প্রকৃত অবস্থা ফুটে উঠেছে তাঁদের তত্ত্বে। তাঁদের তত্ত্বে যদিও কিছু ভুলত্রুটি আছে তথাপি বাস্তবক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ববহ।