অথবা, গিল্ড প্রথা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, আদিম অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে গিল্ড প্রথা ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা,অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে গিল্ড প্রথা বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : গিল্ড প্রথা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সামন্ত সমাজব্যবস্থার মধ্যে গড়ে উঠে। গিল্ড মূলত একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান । মধ্যযুগে সমগ্র সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের শহরগুলো উত্তরোত্তর স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে থাকে এবং সমগ্র শহরের অধিবাসীরা ক্রমশ একটি সুস্পষ্ট সামাজিক শ্রেণি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এরা মূলত শিল্প ও বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল । তারা নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে যে সংঘ সৃষ্টি করে তাই গিল্ড নামে পরিচিত।
অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে গিল্ড প্রথা : মধ্যযুগে ইউরোপ মহাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গিল্ড প্রথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মধ্যযুগে স্কটল্যান্ডের বণিকরা বিভিন্ন সময়ে জমির মালিকদের বিরুদ্ধে এবং নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং ন্যায্য দাবি আদায় করার জন্য এ গিল্ড প্রথার আবির্ভাব হয়। সহজভাবে বলা যায়, জমির মালিকদের তথা সামন্তপ্রভুদের বিপক্ষে বণিকের অবস্থান শক্ত ও মজবুত করে একটি পন্থা বা পদ্ধতিই হলো গিল্ড ব্যবস্থা। গিল্ড প্রথা সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয়। মূলত চতুর্দশ শতকে সারা ইউরোপ জুড়ে গিল্ড প্রথার বিস্তৃতি ঘটে। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বণিকরা বিভিন্ন দেশে মালামাল নিয়ে যাবার নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রথমত তারা সাময়িকভাবে একবারের বাণিজ্যের জন্য এ ধরনের সংঘ গড়ে তুলতো। পরে তা স্থায়ী রূপধারণ করে। প্রথমে সব বণিকই এ সংঘে নিজের ইচ্ছামত যোগ দিতে পারতো। কিন্তু পরে তা শর্তযুক্ত হওয়ায় সংঘে যোগ দিতে বিধিযুক্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত যাদের সম্পত্তি আছে তারাই কেবল গিল্ডের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এছাড়া গিল্ড নানা ধরনের নিয়ম ও বাধানিষেধ প্রবর্তন করে। বণিকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধ করার দিকে গুরুত্বারোপ করে। প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য খরিদ দর ও বিক্রয় দর ঠিক করে দেয় এবং বিক্রয়ের জন্য নির্দিষ্ট কতকগুলো দিন স্থির করে দেয়। গিল্ড প্রথা কেবল অর্থনৈতিক নয়, অন্য কতকগুলো ব্যবস্থারও প্রবর্তন করে, যেমন- বণিকদের সম্পত্তি লুট হয়ে গেলে, আগুনে পুড়ে গেলে গিল্ড হতে সাহায্য করা হতো। এভাবে গিল্ড প্রথা অর্থনীতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক ব্যাপারেও বণিকদের পক্ষ থেকে গিল্ডই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। তাদের চিত্তবিনোদনের জন্য নানান আনন্দ উৎসবেরও আয়োজন করতো। পরে যখন শহরে স্বাধীন নাগরিক জীবন গড়ে উঠে, তখন স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে প্রধান অংশ নেয় এই গিল্ডই। মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যে গিল্ড প্রথা বিকাশ লাভ করে, তার মূল দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ :
১.গিল্ড প্রথা মালিক শ্রমিক বিষয়ক যাবতীয় সমস্যার সুরাহা করে।
২.সব কারিগরই যেন সমান সুযোগ পায়, সেজন্য গিল্ড উৎপাদনের প্রত্যেক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. অর্থাৎ গিল্ড মূল্য ও মজুরি নির্ধারণ করতো।
৪.ব্যবসায় সংক্রান্ত নিরপেক্ষ ব্যবহারিক নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৫.ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে প্রতিটি সদস্যের নিরাপত্তা প্রদান করা।
৬. মধ্যযুগে ইউরোপে গিল্ড কেবল কারিগরদের স্বার্থই রক্ষা করতো, সাধারণ কারিগর কিংবা শিক্ষানবিসদের স্বার্থ এবং অধিকারের দিকে ততটা মনোযোগী বা সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ছিল না। ফলে কারিগর ও সাধারণ কারিগরদের অন্তর্দাহে গিল্ড প্রতিযোগিতা এবং কারখানা মালিকের ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের উপর নির্ভরতার কারণে গিল্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া গিল্ডগুলো বাজারের চাহিদার উপযোগী জিনিসপত্র তৈরি করতে পারতো না। চাহি
দা বেড়ে যাওয়ায় কারখানার উপর কারিগরদের কাজের চাপ এবং মালিকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কারিগর ও মনিবদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে । উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন নতুন কলাকৌশলীর উদ্ভাবন, শিল্পকারখানার আবিষ্কারের ফলে মালিক ও কারিগর তথা উৎপাদন শ্রেণির মধ্যে দৌরাত্ম্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এক সময় গিল্ড প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। প্রতিটি সদস্যের পরিবারের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। গিল্ডের অন্যতম প্রথম কাজ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং উৎপাদন ও বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গিল্ড একটি অর্থনৈতিক সংগঠন। মধ্যযুগের অর্থাৎ ১৪ শতকে ইউরোপের সামন্ত সমাজব্যবস্থায় এবং বিভিন্ন পেশার লোকদের সমন্বয়ে এটা গড়ে উঠেছিল। প্রথম দিকে এ প্রথা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।