অথবা, পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধাসমূহ সবিস্তারে উল্লেখ কর।
অথবা, পল্লি উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান সমস্যাসমূহ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, গ্রামীণ উন্নয়নের সমস্যাবলি সম্পর্কে তোমার অভিমত বিস্তারিত তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ‘পল্লিউন্নয়ন’ বিশ্বে তথা উন্নয়নশীল বিশ্বে আজ একটি পরিচিত শব্দ। ‘পল্লিউন্নয়ন’ বা ‘গ্রামীণ উন্নয়ন’ মূলত একটি ধারণা হিসেবে জন্মলাভ করেছে ১৯৫০ এর দশকে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহে বর্তমানে একটি দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে যে, এসব দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে পল্লিউন্নয়নের কোনো বিকল্প
নেই। জাতীয় উন্নয়নের নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নীতি হিসেবে ‘পল্লিউন্নয়ন’ প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশেই। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহেই ‘পল্লিউন্নয়ন’ ধারণাটি প্রাথমিকভাবে পরিচিতি লাভ করে। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে পল্লিউন্নয়ন বর্তমানে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পল্লিউন্নয়নের অন্তরায় বা সমস্যাবলি : বাংলাদেশের পল্লিউন্নয়নের পথে বিদ্যমান সমস্যাবলি বা অন্ত রায়সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. মূলধনের স্বল্পতা : মূলধনের স্বল্পতাই বাংলাদেশের পল্লিউন্নয়নের অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার অধিবাসীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ফলে গ্রামীণ এলাকার জনগণের মাথাপিছু আয় কম এবং জীবনযাত্রার মানও অত্যন্ত নিচু। এ কারণে গ্রামীণ এলাকায় মূলধনের স্বল্পতা বিরাজ করে। এমতাবস্থায় পল্লিউন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীরা প্রয়োজনীয় মূলধনের যোগান দিতে পারেন।
২. শিক্ষার অভাব : গ্রামীণ এলাকার প্রায় ৮০ ভাগ লোকই হলো নিরক্ষর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অশিক্ষার কারণে গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা কৃষির আধুনিকায়নে উৎসাহ বোধ করেন না। তারা কৃষির আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞ।
৩. দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের অভাব : দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের উপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভর করে। কিন্তু, বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গ্রামীণ নেতৃত্ব মূলত মুষ্টিমেয় অর্ধশিক্ষিত ধনী ও মহাজন শ্রেণির লোভী, অসৎ ও স্বার্থপর প্রকৃতির লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত। তারা গ্রামীণ জনগণকে সংগঠিত করে উন্নয়নের কোন চেষ্টাই করে না, বরং দরিদ্র জনগণকে বিভিন্নভাবে শোষণ করে। ফলে পল্লি এলাকায় দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের অভাবে পল্লিউন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কৃষক, ভূ-স্বামী
৪. অনুন্নত আর্থসামাজিক কাঠামো : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আর্থসামাজিক কাঠামো খুবই অনুন্নত, দুর্বল এবং পশ্চাৎপদ। দীর্ঘদিনের শোষণ, অবহেলা ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গের অদূরদর্শিতার কারণে গ্রাম এলাকায় সুষ্ঠু পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসা ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রভৃতি সুযোগ
সুবিধা পর্যাপ্তভাবে গড়ে উঠেনি। অনুন্নত আর্থসামাজিক কাঠামোর ফলে বাংলাদেশের পল্লিউন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৫. ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা : ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার কারণে গ্রাম এলাকায় জমি মুষ্টিমেয় ধনী কৃষকদের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সেসাথে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। এমতাবস্থায় কোনো উন্নয়ন কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
৬. প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ : বাংলাদেশের গ্রাম এলাকার সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ পল্লিউন্নয়নের পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বা
ল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা, অদৃষ্টবাদিতা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, যৌথ পরিবার প্রথা, বর্ণপ্রথা, পর্দাপ্রথা প্রভৃতি বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ফলে পল্লিউন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
৭. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব : উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়াস ও বাস্তবায়ন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ব্যাপক অভ্যাস থাকায় পল্লিউন্নয়ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায় না।
৮. গণসচেতনতা ও জনগণের অংশগ্রহণের অভাব : শিক্ষার অভাবজনিত কারণে গ্রাম এলাকার জনগণের মধ্যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণের সচেতনতা দেখা দেয় না। ফলে তারা পল্লিউন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে উৎসাহ বোধ করে না। স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
৯. জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ : বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় জনসংখ্যার চাপ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। জনসংখ্যার এ ক্রমবর্ধমান চাপ পল্লিউন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।
১০. কৃষি নির্ভরতা : বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। শুধু কৃষির উপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি অস্থিতিশীল যার জন্য পল্লিউন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে না।
১১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন আঘাত হানছে। ফলশ্রুতিতে পল্লি অঞ্চলের কৃষি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে পল্লিউন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
১২. গ্রামভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব : গ্রামভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব বাংলাদেশে পল্লিউন্নয়নে আরও একটি বিশেষ সমস্যা। আমাদের দেশে পল্লিউন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রাম এলাকার বাস্তব সমস্যার আলোকে আজ পর্যন্ত তেমন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নি। তাই পল্লিউন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য জনগণ উৎসাহবোধ করে না। ফলে পল্লিউন্নয়ন প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করতে পারে না।
১৩. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর অভাব : প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর অভাব আমাদের দেশে পল্লিউন্নয়নের আর একটি অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশে পল্লিউন্নয়নে নিয়োজিত সংস্থাসমূহের অধিকাংশ কর্মীই পল্লিউন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় । ফলে পল্লিউন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
১৪. অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা : গ্রামের রাস্তাঘাট, কাঁচা, আধাপাকা বা ইটা বিছানো। অনেক দুর্গম অঞ্চলে এখন রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। ফলে ঐসব গ্রামের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সময়মতো শহরে বা গঞ্জে পাঠাতে পারে না বা পাঠাতে কৃষরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পল্লিউন্নয়ন মূলত গ্রামীণ উন্নয়ন। গ্রামীণ জনগণের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পল্লি উন্নয়ন পদটি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে পল্লিউন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কতকগুলো সমস্যা রয়েছে বা সঠিকভাবে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে পরিগণিত। এসব সমস্যা দূরীকরণের পন্থা সরকার হাতে নিয়েছে।