১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ ও ফলাফল বিশ্লেষণ কর।

অথবা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : দেশে একটি শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার নিয়ে সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন।
এ নির্বাচনই পাকিস্তানি রাজনীতির ২৪ বছরের ইতিহাসে সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণ : পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালেই সর্বপ্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. ছয় দফা ও এগারো দফার প্রতি সমর্থন : এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছয় দফাকে বাঙালিদের অধিকারের ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবে উল্লেখ করে এবং নির্বাচনে বিজয়ী হলে ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। সুতরাং বলা যায়, ছয় দফা ও এগারো দফা গণমানুষের মনে আবেদন সৃষ্টি করে। যার কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে।
২. ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তির চেতনা : আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক ছয় দফার ভিত্তিতে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে । জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতি তথা ছয় দফার প্রতি ম্যান্ডেট প্রদান করে। পাক ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ হতে বাঙালির মুক্তির ব্যাপক ও তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায় নির্বাচনের ফলাফলে।
৩. বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধতা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল জনগণের ঐক্যবদ্ধতা। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ফলে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে ।
৪. শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল শেখ মুজিবের ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব। তিনি বাঙালিদের একমাত্র নেতা হিসেবে গৃহীত হন। এ সময় আওয়ামী লীগ সত্যিকার অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পেয়েছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই ।
৫. পিপলস পার্টির ভারত বিদ্বেষী মনোভাব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্যতম স্লোগান ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্যদিকে পিপিপি ইসলামি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। আওয়ামী লীগ প্রতিবেশী ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষপাতী, অথচ পিপিপি-র প্রচারণার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ভারত বিদ্বেষ। সুতরাং পিপলস পার্টির অহেতুক ভারত বিদ্বেষ মনোভাবই আওয়ামী লীগকে বিজয় লাভে সহায়তা করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল: ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে পাকিস্তানে প্রথম ও একমাত্র সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। মোট ২৪টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পরিষদের ৩০০টি আসনের জন্য ১,৯৫৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
জাতীয় পরিষদ: আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে। জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানে ৭টি আসনে জয়লাভ করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ৪টি আসনে জয়লাভ করে। নির্দল প্রার্থীরা ৭টি আসনে জয়লাভ করে।
প্রাদেশিক পরিষদ: পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। জামায়াতে ইসলামী ৭টি আসনে জয়লাভ করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) ৪টি আসনে জয়লাভ করে। নির্দল প্রার্থীরা ৭টি আসনে জয়লাভ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ১৯৭০ সালের অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাংলার জনগণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটা সুস্থ ও সাবলীল সমাজব্যবস্থা কায়েম করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দেয় ৷