১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ গঠনের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা মূলত হিন্দুদের রাজনৈতিক সংগঠন। কাজেই মুসলমানগণ তাদের নিজ স্বার্থেই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করে ।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি : ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত এটা ছিল একটি হিন্দুদের রাজনৈতিক সংগঠন। কারণ কংগ্রেসের কিছুসংখ্যক নেতার সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে “বালগঙ্গাধর তিলকের’ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা কংগ্রেসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুসলমানদের সন্দিহান করে তোলে। ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর সিমলায় আগা খানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মুসলিম প্রতিনিধি দল বড়লাট লর্ড মিন্টোর নিকট পৃথক নির্বাচনের দাবি জানালে তিনি নীতিগতভাবে মেনে নেন। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে উপস্থিত
নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রশ্নে আলাপ আলোচনা করেন। স্যার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে নবাব ভিকার-উল-মূলকের সভাপতিত্বে একটি করে ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মহসিন-উল-মূলক ‘মুসলিম লীগ’ নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রস্তাব অভি উপস্থাপন করেন এবং হেকিম আজমল খাঁ তা সমর্থন করেন। মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র রচনার ভার অর্পিত হয় নবাব ভিকার- উল-মূলক ও মহসিন-উল-মূলকের উপর। ১৯০৭ সালে মহসিন- উল-মূলকের মৃত্যুর পর নবাব ভিকার-উল-মূলক একাই মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র রচনার কাজ শেষ করেন। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত আগা খান এ সংগঠনের স্থায়ী সভাপতি ছিলেন । ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় ‘মুসলিম লীগের’ জন্মের সময় এ তিনটি লক্ষ বা উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেগুলো হলো-
১. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য বৃদ্ধি এবং সরকারের নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সরকারের সাথে মুসলিম জনগণের ভুল ধারণা দূর করা।
২. ভারতীয় মুসলিম জনগণের অধিকার ও স্বার্থের সংরক্ষণ এবং উন্নতি সাধনের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় ও আশা আকাঙ্ক্ষার কথা বিনয়ের সাথে সরকারের নিকট পেশ করা।
৩. এ দুইটি উদ্দেশ্য পূরণ করার পাশাপাশি ভারতীয় অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে মুসলিম জনগণের সম্প্রীতিবোধের পথে ছিল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এ সংগঠনের তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া’।
১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ গঠনের প্রেক্ষাপট: ১৯০৬ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর ঢাকায় ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ঐ সময়ের ব্রিটিশ ভারতে ক্রমবর্ধমান হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য এই লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ: ব্রিটিশরা মনে করেছিলেন যে এই বিদ্রোহের মূলে ছিল মুসলিমরা।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা: হিন্দুদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য এই দলটি গঠিত হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ: বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ভূমিকা: উনিশ শতকের শেষার্ধে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলেন।
উল্লেখযোগ্য কারণ: হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান: ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে।
মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার: মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব: সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব কম ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা: শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিমরা হিন্দুদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল।
মুসলিম লীগের লক্ষ্য: মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করা মুসলিমদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপন করা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। এই লীগ পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ – মুসল ধারায় মুসলমানদের ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রেক্ষিতে গঠিত হয় মুসলিম লীগ । তাই ভারতের ইতিহাসে মুসলিম লীগের গুরুত্ব অপরিসীম ।