১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতের শাসনতাত্ত্রিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সর্বশেষ এবং সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন। ভারতের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে তিনি ভারতের বিভক্তি ছাড়া ভারতে শাস্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণা কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীতে কলকাতায় মুসলিম লীগের জনসভা চলাকালে ঘে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয় তাতে কংগ্রেসও ভারত বিভাগ প্রস্তাব মেনে নেয়।
অতঃপর লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভারতবর্ষকে বিভক্তির মাধ্যমে ভারতীয় শাসন পরিকল্পনায় ঘেসব সুপারিশ করেন, সেগুলোকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতা প্রদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতার মর্ধাদা দিতে ইতিঃপূর্বে বিভিন্ন দফায় যে শাসনতান্ত্রিক দলিল সম্পাদন করে তন্মধ্যে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ছিল টুড়ান্ত আইন। এ আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের বৈশিষ্ট্য ৰা ধারাসমূহ : ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। শেষ পর্যন্ত এ আইনের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শীসনের অবসান ঘটে। নিয়ে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের বৈশিষ্ট্য বা ধারাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. পুথক ভোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা : ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ভারতবর্ধকে বিভক্ত করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক ডোমিনিয়ন স্থাপন করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ও পার্লামেন্টেরকোন আইন বা আদেশ স্বাধীন সার্বভোম এ ডোমিনিয়ন দুটির উপর কার্যকরী হুবে না৷
২. গণপরিষদ গঠন : ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যে দুটি ডোমিনিয়ন গঠন্ন করা হয়, তা ছিলএকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তবে ডোমিনিয়ন দুটির জন্য দুটি গণপরিষদও গঠন করা হয়। গণপরিষদের হাতে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং নতুন শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত গণপরিষদ কেন্দ্রীয় আইনপরিষদ হিসেবে কাজ করে যাবে স্থির হয়৷ এক্ষেত্রে বলা হয় যে, গণপরিষদ দুই ধরনের কাজ করবে৷ যথা : ভবিষ্যতের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা ও কেন্দ্রীয় আইনসভার কাজ।
৩. ভোমিনিয়নদ্য়ের পরিধি ও সীমানা: এ আইনের মাধ্যমে আসামের সিলেট জেলা, পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাঞ্তাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্থান নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয় এবং পশ্চিম বাংলা, পূর্ব পাঞ্জাব ও ভারতেরঅবশিষ্টাংশ নিয়ে ভারত গঠিত হবে।
৪. ভোমিনিয়ন দুটির শাসনব্যবস্থা : এতে বলা হয়েছে যে, নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ভোমিনিয়ন ও তাদের অন্তর্গত প্রদেশগুলো ১৯৩৫ সালের যে ভারত শাসন আইন সে অনুযায়ী শাসিত হবে। তবে ঘদি প্রয়োজন মনেকরে তাহলে প্রতিটি ডোমিনিয়ন ভারত শাসন আইন সংশোধন করতে পারবে। ৫. ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণযুক্ত : ভারতবর্ষের যে কোন সংবিধান সংস্কার এবং নতুন আইন প্রণীত হতো বিটিশ পার্লামেন্ট থেকে৷ কিন্তু এ আইনের পর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রণীত আইন ভারত ও পাকিস্তানের উপর প্রযোজ্য হবে না।
৬. দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর থেকে ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান : এ আইন পাস হওয়ার পূর্বে দেশীয় রাজ্যগুলোর উপরব্রিটিশ রাজ্যের কর্তৃত্ব ছিল নতুন আইন দ্বারা দেশীয় রাজ্যগুলোর উপর হতে ব্রিটিশ রাজ্যের কর্তৃত্বের অবসান করা হয়৷ এআইনে বলা হয় যে, দেশীয় রাজ্যগুলো নিজ ইচ্ছামতো ঘে কোন ডোমিনিয়নে যোগদান করতে বা স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে।
৭. কমনওয়েলথ: এর সদস্যভুক্ত হওয়া সম্পর্কে স্ব-স্ব আইনপরিষদের সিদ্ধান্ত এতে বলা হয় যে, নব সুষ্ট দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে থাকবে কি না তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ডোমিনিয়ন দুটি স্ব-স্ব আইনপরিষদ ঘা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তাই চুড়ান্ত বলে পরিগণিত হবে।
৮. গভর্নর জেনারেল নিয়োগ: এতে বলা হয় যে, প্রত্যেক ডোমিনিয়নের জন্য একজন গভর্নর জেনারেল থাকবেনাডোমিনিয়ন মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে তিনি ব্রিটিশ রাজা বা রানী কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। গভর্নর জেনারেল ডোমিনিয়নেরশাসনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ৯. গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের স্বৈরাচারী ক্ষমতার অবসান: এ আইনে গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের ব্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা, ব্ডিরিবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা এবং বিশেষ দায়িত্ব লোপ করা হয়। এতে বলা হয় যে, গভর্নর জেনারেল শাসনকার্ধপরিচালনার ক্ষেত্রে ডেমিনিয়ন মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
১০. প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ: সদস্যদের নিয়োগ প্রাদেশিক শাসনকার্ঘ পরিচালনার জন্য মন্ত্রিদের নিয়োগের ক্ষেত্রেগভর্নর জেনারেল এর প্রাধান্য থাকবে। এতে বলা হয় ঘে, ডেমিনিয়ন মন্ত্রীদের বা মন্ত্রিপরিষদের নিয়োগ করবেন।
১১. ভারত সচিব পদের অবসান: ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইন পাস হওয়ার পর থেকে যে ভারত সচিব পদ ছিলতার অবসান করা হয় এবং শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে ভারত সচিবের দায়িত্ব কমনওয়েলথ সচিবের উপর অর্পণি করা হয়।
১২. কর্মচরীদের বেতনভাতা নির্ধারণ : পূর্বে কোম্পানির শাসনের জন্য জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়ে গিয়েছিল। এছাড়া ভারত সচিব কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীদের বেতনভাতা সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন ছিল না। নতুন আইনে। ভারত সচিব কর্তৃক নিযুক্ত রাষ্ট্রীয় কর্মচারী এবং ফেডারেল কোর্ট ও হাইকোটের বিচারকদের বেতন, ছুটি, পেনশন প্রভৃতিসংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
১৩. সীমানা কমিশন গঠন : বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান করবে কি না তা ভোটেরমাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে৷ ঘদিও ভোটের মাধ্যমে বিভক্ত করা হয় তথাপিও বিভক্ত প্রদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণের জন্য ‘সীমানা কমিশন’ নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়।
১. বিবিধ : এছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বা ধাপগুলো নি্মরূপ :
ক. সিন্ধু প্রদেশ ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান করবে কি না তা সে প্রদেশের আইনসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
খ. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ভারত না পাকিস্তানে যোগ দিবে তা প্রদেশের আইনসভা সিদ্ধান্ত নিবে। বাংলাকে বিভক্ত করা হলে আসামের সিলেট জেলা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান প্রদেশের সাথে যুক্ত হবে কি না তা নির্ণয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। মূল্যায়ন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেশ বিভক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে মুসলিম লীগ সাদরে গ্রহণ করে। কারণ মুসলিম লীগের দাবি ছিল জাতিগতভাবে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা। তবে পাঞ্জাব, সীমান্তপ্রদেশ, বেন্চিস্তান, বাংলাদেশ ও আসাম নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে দাবি তারা করেছিল তা বাস্তবায়িত হয় নি। মুসলিম লীগকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও অঙ্গকর্তিত পাকিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগ মুসলিম লীগকে মেনে নিতে হয়। তবে মুসলিম লীগের একাংশ ভারত বিভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। শেষে তারা জিন্নাহর সাথে একমত্যে আসেন। ফলে ভারতের জনসাধারণের দীর্ঘদিনের যে স্বপ্ন তা বাস্তবরূপ লাভ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিশ্বের মানচিত্রে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র স্থান লাভ করে। এছাড়া ভারত বিভক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। ফলে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাই এবং প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। অন্যদিকে, ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তবে এতে প্রমাণিত হয় ঘে কংগ্রেসের আন্দোলন পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসন অবসানের আন্দোলন ছিল না। কারণ ভারত বিভক্ত হলেও তারা ব্রিটিশ লেজুড়বৃততি ত্যাগ করে নি। এছাড়া বলা যায়, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য ঘাই থাক বিভক্তি হওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন অধ্যায়ের স্না হয়, যা ছিল প্রশংসনীয়।