সুশীল সমাজের ভূমিকা আলোচনা কর ।

অথবা, সুশীল সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সুশীল সমাজের ভূমিকা নিরূপণ কর।
অথবা, সুশীল সমাজের ভূমিকা লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বর্তমান বিশ্বব্যাপী Civil Society বা সুশীল সমাজ প্রত্যয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ, যথার্থ উন্নয়ন আনয়ন, সামাজিক সচেতনতা ও শিক্ষা বৃদ্ধি তথা সার্বিকভাবে রাষ্ট্র যন্ত্রকে অধিক কার্যকরী ও ফলপ্রসূ করতে সুশীল সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার সাথে সাথে এ সমাজের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব দ্রুতভাবে বাড়ছে। রাষ্ট্রকে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই।
সুশীল সমাজের ভূমিকা : রাষ্ট্রকে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সুশীল সমাজের ভূমিকা প্রতিটি
সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে সুশীল সমাজের ভূমিকা আলোচনা করা হলো :

  1. To keep the state civil and non-intrusive : আধুনিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যে কোনো সময় জনগণের অধিকার হরণ করতে পারে। এ সমস্যার হাত থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য ‘Principle of separation of power’ এর ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে executive, legislalure ও
    judiciary এ তিনটি বিভাগের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার মাধ্যমে একটি ‘checks and balances’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে শোষণ যন্ত্রে পরিণত হতে বাধা দেয়।
  2. The fourth brance of the state : আমরা জানি আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আইন
    বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ- এ তিন বিভাগের মধ্যে বণ্টিত। রাষ্ট্রের এ তিন বিভাগের বাইরে অনানুষ্ঠানিকভাবে
    সুশীল সমাজ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে কাজ করে যথার্থ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়
    সহায়তা করে।
  3. Enhancing the quality of governance : আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম মূল দর্শন হলো মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র নিবেদিত থাকবে। আর মানুষের কল্যাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা পর্যালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সুপারিশ ও পরামর্শ প্রদান করে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারকে
    কোনো সংস্কার বা মঙ্গলজনক কাজ করতে বাধ্য করে। তারা জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কাজ করে। এসব কাজের মাধ্যমে তারা সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই যথার্থ ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও সেবাপ্রদান নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখে।
  4. To promote and organized voluntary citizen action : রাষ্ট্র এককভাবে জনগণের সার্বিক চাহিদা মোকাবিলা বা সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। স্থানীয় নেতৃত্ব, উদ্যোগ এবং সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে সংগঠিত নাগরিক সংগঠনগুলো স্থানীয়ভাবেই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজ স্থানীয় জনগণের সাথে
    কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মাধ্যমে তাদেরকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
  5. To help to create social capital : লোকজন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সময় তাদের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের মূলধন (Capital) সৃষ্টি হয়, যা আর্থিক মূলধন (Financial capital) হতে পৃথক। এটাকে সামাজিক মূলধ (Social Capital) বলে। এ সামাজিক মূলধনের উৎস হলো : জনগণের মধ্যকার ঐক্য ও পারস্পরিক আন্তঃসংযুক্ততা
    এবং কোনো বিশেষ একই উদ্দেশ্যে সকলে মিলে কাজ করা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যে সমাজে যত বেশি সৌহার্দ্য বিদ্যমান এবং যত বেশি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে সমাজ তুলনামূলকভাবে তত বেশি ভালো এবং কল্যাণকর। আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে এ বিষয়টির ব্যাপক অভাব বিদ্যমান। এটা আর্থিক মূলধ (Financial capital) এর গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হতে পারে। সুশীল সমাজ প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাগরিকদেরকে
    প্রভাবিত করার মাধ্যমে এ সামাজিক মূলধন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
  6. To establish decency, fairness and democratic rights in the society : ‘সুশীল সমাজ’ বিবেক হিসেবে কাজ করে । এটা নাগরিকদেরকে রাষ্ট্রের শোষণ নিষ্পেষণ হতে রক্ষা করে। এজন্য সুশীল সমাজ রাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক তথা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ, নাগরিকদেরকে সংগঠিতকরণ এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজে যথার্থ, ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে।
  7. The establishment of scrupulous compliance of provisions of the constitution : সংবিধান হলো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এতে নাগরিকদের অধিকার, দায়িত্ব, কর্তব্য, সুযোগ সুবিধা, সকল কিছু সুনির্দিষ্ট
    করা থাকে। এক্ষেত্রে সরকার যদি সংবিধান অনুসারে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, জনগণকে যথার্থ অধিকার না দেয়, তবে সিভিল সোসাইটি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে যথার্থ দায়িত্ব পালন ও জনগণকে যথাযথ অধিকার প্রদানে যথার্থ সমঝোতায় আসতে বাধ্য করে দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
    ৮. To ensure the existence the rule of law : জনস্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিটি দেশেই কমবেশি ৩তটি আইন রয়েছে। কিন্তু শাসকরা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার আওতায় নিয়ে অবিচারের মাধ্যমে জনস্বার্থ ও অধিকার লঙ্ঘন করে। এসব ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
  8. To ensure the existence of organized non-state interest group : জনকল্যাণকামী গণতান্ত্রিক শাসন ও সমাজব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দেশের অভ্যন্তরে বেসরকারি সংগঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের যথার্থ
    কার্যকারিতা প্রয়োজন । কিন্তু আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশের সরকার এসব প্রতিষ্ঠানকে দেশের জন্য ক্ষতিকর ও
    শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে সুশীল সমাজ দেশের অভ্যন্তরে non-state group এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারে।
  9. To ensure the existence of a balanced pluralism : উদার গণতান্ত্রিক দেশ ছাড়া যথার্থ জনকল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে একদল আর একদলের উপর মতামত চাপিয়ে
    দিতে চায়। একদল অন্য দলকে শোষণ করে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এসব সমাজের যথার্থ কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে balanced pluralism প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজ নিবিড় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে
    গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
  10. Economic and social development : সুশীল সমাজ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ, সচেতনকরণ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, সরকারকে পরামর্শ প্রদান, সরকারকে কর্মসূচি প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারে।
    উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা হতে দেখা যায় যে, জনগণের যথার্থ ও সার্বিক কল্যাণের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উপদল ও সুবিধাপ্রাপ্ত বা ভোগী গোষ্ঠী সুশীল সমাজের
    কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। তাই এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা আরও জোরদার করা প্রয়োজন ।