সুফিবাদ কাকে বলে? তাসাউফ বা সুফিবাদের সাথে গোঁড়া মুসলমানের সম্পর্ক নির্ণয় কর।

উত্তর : ভূমিকা : সুফিবাদ হলো একটি আধ্যাত্মিক দর্শন। সুফি সাধকের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হলো আল্লাহর সান্নিধ্যে থেকে তার দীদার লাভ করা। সুফি সাধকরা বাতিনী ও যাহিরী উভয় দিককেই ইসলামের সঠিক পথ বলে মনে করেন। এ জন্যই মূলত আমরা গোঁড়া মুসলমান ও সুফিবাদের মধ্যে
কিছুটা পার্থক্য লক্ষ করি।
সুফিবাদ : সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মূলকথা। পরম সত্তা মহান আল্লাহ্‌কে জানার এবং আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন
স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যমে জানার প্রচেষ্ঠাকে সুফিবাদ বলা হয়।
১. আল কুশাইরী এর মতে, “বাহ্য ও অন্তর জীবনের বিশুদ্ধতাই সুফিবাদ।”
২. হযরত ইমাম গাজালি (র.) এর মতে, “আল্লাহ্ ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর
আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে।”
সুতরাং সুফিবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ যেখানে নিজেকে পার্থিব জীবনের সুখ ও সম্পদের প্রলোভন থেকে মুক্ত করে অনাড়ম্বর ও নির্লোভ জীবনাচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব
আরোপ করা হয়
→ সুফি ও গোঁড়া মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ক বা পার্থক্য : সুফি ব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ইসলামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকের সমন্বিত রূপকে ইসলামের পূর্ণরূপ বলে মনে করেন এবং সেভাবে ইবাদত-বন্দেগী ও সাধনা করে আল্লাহ্র পথে ধাবিত হন। পক্ষান্তরে যিনি শুধুমাত্র ইসলামের বাহ্যিক দিককেই একমাত্র সঠিক পথ বলে মনে করেন এবং কুরআন ও হাদিসের অভ্যন্তরীণ অর্থ গ্রহণ না করে শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করেন
এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক ভাবে ইবাদত বন্দেগী করেন তিনি হলেন গোঁড়া মুসলিম। সুফি ও নিচে আলোচনা করা হলো-
১. জ্ঞানের উৎসের প্রতি গুরুত্ব : ইসলাম আসল, নকল ও কাশফের প্রতি সমান গুরুত্ব প্রদান করে মানুষের জ্ঞানের তিনটি উৎস নির্দেশ করে। গোঁড়া মুসলমানরা নকলের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং আকলের উপর কম গুরুত্বদেন। কিন্তু সুফিরা আকল ও নকলের উপর যতটা গুরুত্ব দেন তার চেয়ে
বেশি দেন কাশফের উপর।
২. কালেমার অর্থ : সুফিরা কালেমা তাইয়্যেবা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূরুল্লাহ” বলতে বোঝেন যে, তিনি ব্যতীত কোনো সত্তাই নাই। কিন্তু গোঁড়া মুসলমানদের মতে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ অর্থ হলো আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, হযরত মুহাম্মদ
(স.) তার প্রেরিত রাসূল। মুসলমানেরা এর বাহ্যিক অর্থ ধরেন। আর সুফিরা এর বাহ্যকি অর্থ ব্যতীত অভ্যন্তরীণ অর্থের সন্ধান করেন।
৩. কুরআনের অর্থ : গোঁড়া মুসলমানরা কুরআনের শাব্দিক অর্থের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু সুফিরা কুরআনের
বাহ্যিক অর্থের পাশাপাশি এর অভ্যন্তরীণ অর্থই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।

  1. আল্লাহর সাথে সম্পর্ক : গোঁড়া মুসলমানদের মতে, আল্লাহ্ ও মানুষের মধ্যে একটি মাত্র সম্পর্কই বিদ্যমান তাহলো
    প্রভু-ভৃত্য সম্বন্ধ। পক্ষান্তরে সুফিগণ আল্লাহর সাথে বহুবিদ সম্পর্ক কল্পনা করেন; তার মধ্যে আশিক-মাশুকের সম্পর্কই প্রধান। প্রায় প্রত্যেক সুফিই আল্লাহকে মাশুক বা প্রেমাস্পদ মনে করেন এবং নিজেকে তার আশেক বা প্রেমিক মনে করেন।
    ৫. বেহেশতের আশা: গোঁড়া মুসলমানরা বেহেশত লাভের আশায় ইবাদত বন্দেগী করেন। পক্ষান্তরে সুফিরা ইবাদত বন্দেগী করেন আল্লাহর প্রেমে উদ্ভূত হয়। একমাত্র আল্লাহ্‌কে পাবার আশায়। তাই তাদের মাঝে বেহেশেতের লোভ থাকে না।
    ৬. শরিয়তের বিধান পালন: গোঁড়া মুসলমানরা শরিয়তের বিধান পালনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে সেটাকে মহা অপরাধ বলে মনে করেন। কিন্তু সুফিরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ
    করেন। কিন্তু এক ধরনের সুফি আছে যারা আল্লাহর প্রেমে এতই মশগুল যে, তাদের শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য নয়। তারা
    সাধারণ বিধি বিধানের উর্ধ্বে জগতের মানুষ।
    ৭. ধর্মীয় নীতি অনুসরণ : গোঁড়া মুসলমানের ধর্মীয় নীতিসমূহ বিনা বিচারে গ্রহণ করেন এবং পালন করে থাকেন।.এরূপ ধর্মাচারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের আদেশ ও অন্ধবিশ্বাস কাজ করে থাকে। পক্ষান্তরে, সুফিরা ধর্মীয় নীতি ও নিয়ম-কানুন
    বিচার বিবেচনা করে পালন করে থাকেন। তারা ইবাদতের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে প্রেম সহযোগে তা সম্পাদন করেন।
    ৮. পথ প্রদর্শকের প্রয়োজনীয়তা : গোঁড়া মুসলমানগণ ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে অভ্যন্তরীণ কোনো শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও পথ প্রদর্শক বা পীরের প্রয়োজনীয়তাকে তাঁরা
    অস্বীকার করে থাকেন। পক্ষান্তরে সুফিগণ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় বিধি বিধানের উপর সমান গুরুত্ব প্রদান করেন এবং
    আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার জন্য আলোকিত পীর বা সুফি মুরশিদের তত্ত্বাবধায়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং এরূপে কাজ করে থাকেন।
    ৯. আত্মা সম্পর্কে : গোঁড়া মুসলমানদের মতে, মৃত্যুর পর আত্মা পরিপূর্ণ স্বকীয়তা বজায় রাখবে এবং পাপ পুণ্যের হিসাব শাস্তি ও পুরস্কার লাভ করবে। কিন্তু সুফিদের মতে, পূর্ণ মানবের আত্মা সম্পূর্ণভাবে বিশ্ব আত্মা আল্লাহর মধ্যে বিলুপ্ত বা সমাহিত হয়ে অমরত্ব লাভ করবে।
    ১০. ঈমানের স্তর : গোঁড়া মুসলমানগণ ঈমানের স্তর সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং তারা এটা অস্বীকার করেন। কিন্তু সুফিদের মতে ঈমানের কতিপয় স্তর আছে এবং সর্বশেষ স্তর
    লাভ করলেই প্রকৃত মুমিন হওয়া যায়।
    ১১. সংগীত : গোঁড়া মুসলমানগণ মনে করেন যে, সর্বপ্রকার সংগীত হারাম ও নাজায়েয। কিন্তু অধিকাংশ সুফি ধর্ম সংগীতকে
    জায়ে মনে করেন, এবং আল্লাহ্ প্রাপ্তির জন্য এ ধরনের সা’মা, গজল, কাওয়ালী প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
    ১২. আত্মার ক্রমবিবর্তন : গোঁড়া মুসলমানগণ কবর, কিয়ামত, হাশর, দোযখ, কতিপয় দৈহিক অবস্থান্তর ব্যতীত আত্মার ক্রমবিবর্তন সম্পর্কে বেশি কিছু জানেন না। কিন্তু
    সুফিগণ আত্মার ক্রমবিবর্তন বিশ্বাস করেন এবং ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমেই আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী
    ১৩. ইহকাল ও পরকাল : গোঁড়া মুসলমানগণ ইহকাল ও পরকাল এই দুই বিপরীতমুখী জগৎ আছে বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সুফিগণ এই দুই জগৎকে একই সূত্রে দেখতে পান।
    উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, গোঁড়া মুসলমান ও সুফিতত্ত্বের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। সুফিরা যাহিরী ও বাতিনী উভয় দিকের সমন্বয়কারী, কিন্তু গোঁড়া মুসলমানগণ
    শুধুমাত্র যাহিরী দিকের স্রষ্টা। সুফিগণ যাহিরী, বাতিনী উভয় দিক থেকে পূর্ণ কিন্তু গোঁড়া মুসলমানরা সে দিক থেকে আংশিক।
https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%9a%e0%a6%a4%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%a5-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%b8%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%a4%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf-%e0%a6%86/