সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক বাহনগুলো কী?

অথবা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক বাহন সম্বন্ধে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝায় এমন পন্থা, পদ্ধতি যা সমাজের সদস্যদের অসংযত ও সমাজ বিরোধী আচরণ এবং ক্ষুদ্রবৃত্তি দমন করতে এবং সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলাবোধ জাগিয়ে তুলে সমাজকে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিপথগামীদের প্রতি সমাজের একটি প্রতিক্রিয়াশীল উপায় বা পন্থা যা বিপথগামীদের শাস্তি দেয়া বা তার চরিত্রকে সমাজস্বীকৃত পন্থায় সংশোধন করে নির্দিষ্ট ধারায় প্রবাহিত করে।
সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক বাহন : সামাজিক নিয়ন্ত্রণের আধুনিক বাহনগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. জনমত : E. A. Ross এর মতে, “সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন হিসেবে জনমত খুবই কার্যকরী।” মানুষ জনমতকে শ্রদ্ধা করে, জনমত অনুসারে চলতে পছন্দ করে। বিবেকবান কোন মানুষ জনমতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। তাই জনমতের ভয়ে মানুষ নিজেকে সংশোধন করে।
২. গণমাধ্যম : আধুনিক বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমন- রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, চলচ্চিত্র, ইন্টারনেট, গান, কবিতা, নাটক, বক্তৃতা প্রভৃতি সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষ আধুনিক এ ধরনের কোন না কোন গণমাধ্যমের সংস্পর্শে থাকে এবং এগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ ধরনের গণমাধ্যম মানুষকে সংশোধিত পথে পরিচালিত করে।
৩. রাষ্ট্র : রাষ্ট্র আধুনিক গণমাধ্যমসমূহের অন্যতম মাধ্যম। সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুরোপুরি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে থাকে। সমাজের সুস্থ, সুন্দরজীবন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করে। যে কোন ধরনের গোলযোগ ও অপরাধকে রাষ্ট্র শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান সরকারের গঠিত স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন- পুলিশ, র‍্যাব, আর্মি প্রভৃতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসে।
৪. আইন : আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্র সম্পাদন করে। আইন জনসাধারণকে অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে এবং আইন অনুযায়ী কাজ করতে উৎসাহিত করে। অসামাজিক কাজের জন্য শাস্তি প্রদান এবং আইন অনুযায়ী কাজের পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আইন সামাজিক নিয়ন্ত্রণে পরিশেষে ভূমিকা রাখে।
৫. ধর্ম : ধর্ম মানুষকে অনুশাসনের মাধ্যমে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী এবং ধর্মীয় বিধান মেনে চলতে চেষ্টা করে । কোন সামাজিক আচরণের বিষয় কেউ জানতে না পারলেও ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহ সমস্ত কিছু সম্পর্কে অবগত । সবাইকে ফাঁকি দেয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া যায় না। আল্লাহর ভয়েই মানুষ অসামাজিক আচরণ পরিহার করে।
৬. পরিবার : মানুষ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, পরিবারেই বড় হয় এবং পরিবারেই মৃত্যুবরণ করে। Blair J. Kalasa পরিবার প্রসঙ্গে বলেছেন, “The first and the fundamental socialize of the individual.” মানুষ পরিবার থেকে সামাজিক আচরণের শিক্ষা গ্রহণ করে। পরিবার থেকেই শিশু কোনটি সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং কোনটি অস্বীকৃত সে শিক্ষা গ্রহণ করে। মন্দ কাজের জন্য শাস্তি প্রদানে পরিবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণে অংশগ্রহণ করে।
৭. উৎসব বা অনুষ্ঠান : মানুষ সমাজ জীবনে বিভিন্ন উৎসব বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি উৎসব বা অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট কারণ থাকে এবং নির্দিষ্ট পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করে অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। কিছু কিছু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝিয়ে দেয়া হয়। এভাবে উৎসব অনুষ্ঠান সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা রাখে।
৮. শিল্পকলা : শিল্পকলায় শিল্পী তার রং তুলির আঁচড়ে জীবনের হাসি-কান্না, প্রত্যাশা, বঞ্চনা, আইন আদালত , অভিযোগ, ব্যথা, সবকিছু ফুটিয়ে তোলে। বিভিন্ন ধরনের শিল্প, ফটোগ্রাফি মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যৌতুকের দাবি না মিটাতে পেরে স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালানোর দৃশ্য শিল্পী রং তুলিতে ফুটিয়ে
তুলতে পারলে এর প্রতি সবাই সমবেদনা প্রকাশ করে। মানুষের আচরণ এভাবে নিয়ন্ত্রিত পথে চলে আসে।
৯. পৌরাণিক কাহিনী : মানুষ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী থেকে ন্যায় অন্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করে। পৌরাণিক কাহিনী মনঃপ্রসূত ঘটনায় সমৃদ্ধ হলেও এর আবেদন মানব হৃদয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। পৌরাণিক কাহিনী মানুষকে নীতিজ্ঞানের শিক্ষা দেয়। এভাবে পৌরাণিক কাহিনী মানুষকে কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করে।
১০. ব্যক্তিত্ব : সমাজে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ধার্মিক, ইমাম, সম্মানিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অনুকরণীয় মডেল হিসেবে কাজ করে। উন্নত ব্যক্তিত্বের প্রভাবে মানুষ উন্নত মানসিকতা গড়ে তোলে। উন্নত মানসিকতার প্রভাবে মানুষ নিয়ন্ত্রিত আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বলতে বুঝায়। মানব জীবনের বিশেষ অনুসরন নীতি দ্বারা সমাজস্থ মানুষের আচার আচারণ পরিলক্ষিত হওয়া। বর্তমান সমাজে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে চলছে। ব্যাপক কর্মহীনতা বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি কারণে সমাজে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সবধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাহন প্রায় অকার্যকরী হয়ে পড়ছে। তবে গণমাধ্যমগুলো প্রতিদিন মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।