অথবা, সামাজিক অসমতার প্রকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতার প্রকৃতি সম্পর্কে বিবরণ দাও।
অথবা, সামাজিক অসমতার প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, সামাজিক অসমতার প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক অসমতা আলোচনা করার পূর্বে আমরা এখানে আলোচনা করব সামাজিক অসমতা কেমন করে কোথা থেকে এসেছে আমরা যদি পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করি তাহলে দেখব পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে এর পরিবেশ পরিস্থিতি এবং জীবনধারণ পদ্ধতি ব্যবস্থা বর্তমানের ন্যায় ছিল না। মানুষ যখন শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত তখন নারী পুরুষ একত্রে দল বেঁধে শিকারে যেত এবং শিকারীরা সবাই একই ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করত (নারী পুরুষ নির্বিশেষে) ধীরে ধীরে শিকারী মানুষ যখন সভ্য হতে শুরু করল, চাষাবাদের আবিষ্কার করল, স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন দেখা দিল তখন তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা মনে দানা বাঁধতে লাগল। এ সময় তাদের মনে ধীরে ধীরে এ ধারণা জন্মাতে লাগল যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করে। এ থেকে তারা সম্পত্তি গড়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ প্রতিযোগিতায় যারা অধিক সম্পত্তি করতলগত করতে পারে তারা মালিক শ্রেণি এবং যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি করতলগত করতে পারে নি তারা শ্রমিক বা দাস শ্রেণিতে পরিণত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে শিকারী মানুষের মনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্রেক হয় এবং তা থেকে সমাজের মানুষের মনে মালিক শ্রমিক ধারণা হয় এবং শুরু হয় সামাজিক অসমতা বা Soial Inequality.
সামাজিক অসমতার প্রকৃতি : ‘Dictionary of Sociology’ তে বলা হয়েছে সমাজে পারিবারিক ঐতিহ্য, সামাজিক রীতি, সম্পদ, আয়, রাজনৈতিক প্রভাব, শিক্ষা, আচার ব্যবহার এবং নীতির পার্থক্যের ভিত্তিতে সামাজিক খ্যাতিতে যে পার্থক্য সূচিত হয় সেটাই সামাজিক অসমতা। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে লক্ষণীয় বিভিন্ন মাত্রার সামাজিক ক্ষমতা, বিশেষ সুযোগ সুবিধা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, মূলত সামাজিক অসমতার মাত্রা ও প্রকারভেদকেই বুঝিয়ে থাকে। নিউগিনির কিওয়াই পাপুয়ান সমাজ থেকে নেওয়া এথনোগ্রাফিক তথ্যের আলোকে স্মেলসার বলেছেন, পাপুয়ান অপরের তুলনায় বেশি সুনাম, সুখ্যাতি ও কর্তৃত্বের অধিকারী। সেখানে যে ব্যক্তি বেশি মেহমান আপ্যায়ন করে এবং সমাজে খাদ্য, তামাক ও সম্পত্তিতে সবার সমান অধিকার। কারণ এগুলো দুষ্প্রাপ্য নয়, কিন্তু সেখানে কেউ কেউ একে জাদুবিদ্যা, যুদ্ধ, শিকারে বেশি সাফল্য অর্জন করে সে অন্যদের চেয়ে বেশি সুনাম ও সাফল্যের অধিকারী হয়। এসব কাজে সাফল্য অর্জনের যোগ্যতা ও গুণাবলির অর্জন অনেকটা দুর্লভ। সুতরাং বলা যায়, মূল্যবান কাঙ্ক্ষিত ও দুষ্প্রাপ্য জিনিসের অসম বণ্টন অথবা এতে অসম অধিকারই অসমতা তৈরি করে। বিশ্বের বৃহৎ জাহাজ টাইটানিক সমুদ্রে নিমজ্জিত হলে দুর্ঘটনায় তা ডুবতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। এ সময় যাত্রীদের জীবন রক্ষার্থে সামাজিক মূল্যবোধ থেকে শিশু এবং নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে মহিলা ও শিশুর ৬৯% এবং বয়স্কদের ১৭% এর জীবন রক্ষা পায়। এ জীবন রক্ষায় সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থানও লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, উচ্চ সম্পদশালী শ্রেণির জীবন রক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে প্রথম শ্রেণির জীবন রক্ষা পায় ৬০%, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪৪% এবং তৃতীয় শ্রেণির ২৬% যাত্রীর প্রাণ রক্ষা পায়। এ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত সব মানুষের কাছেই তার জীবন ছিল সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। এ মূল্যবান জীবন বাঁচানোর প্রয়াস ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে অসম বণ্টন আমরা লক্ষ্য করলাম। এ কারণে অন্য শ্রেণির চেয়ে প্রথম শ্রেণির যাত্রীর প্রাণ রক্ষায় বেশি প্রয়াস নেওয়া হয়। তাই একথা বলা যায়, সব যুগে সর্বত্রই কাঙ্ক্ষিত, মূল্যবান ও দুর্লভ সামগ্রী বণ্টনের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ ধরনের
বিষয়বস্তুতে অসম অধিকার বা অসম বণ্টনই সামাজিক অসমতার মূলে বেশি ক্রিয়াশীল। জন্মের পর মানব শিশু লক্ষ্য করে যে, সমাজে কাঙ্ক্ষিত জিনিসে সবার সমান অধিকার নেই। অবশ্য বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন জিনিসকে কাঙ্ক্ষিত জিনিস বলে মনে করা হয়। কাঙ্ক্ষিত জিনিসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. বস্তুগত- (খাবার, সোনাদান ইত্যাদি) ও
২. অবস্তুগত- (শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব।
বস্তুগত বা অবস্তুগত যাই হোক না কেন কাঙ্ক্ষিত জিনিসের বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো দুর্লভ বা দুষ্প্রাপ্য। অর্থাৎ, এর চাহিদা যোগানকে ছাড়িয়ে যায়। সবার দ্বারা প্রচুর সম্পদশালী বা বিখ্যাত হওয়া সম্ভব নয়। খুব স্বল্পসংখ্যক লোক অন্যদের তুলনায় দুর্লভ বা মূল্যবান জিনিসে বেশি অধিকার লাভ করে । বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে এটা খুব সহজেই বুঝা যায়। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে একপ্রকার বানর দেখা গেছে, যাদের পালের নেতৃত্ব দেয় সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী বানরটি। শক্তি বলেই সে অন্যান্য বানরকে তার হুকুম পালন করতে বাধ্য করে। তবে মানুষের সমাজে অসমতার ভিত্তি কেবল দৈহিক শক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে ব্যক্তির গুণাবলিই
বেশিরভাগ অসমতার জন্য দায়ী। ঐ সমাজে বয়স, সাহস ও শক্তি বলে মানুষ দুর্লভ জিনিসের অধিকারী হতো। বর্তমানে আধুনিক জটিল সমাজে খ্যাতি অর্জনে ব্যক্তির নিজস্ব গুণের সাথে সামাজিক উপাদানসমূহ যুক্ত হয়। যেমন- পৈত্রিক সম্পদ
Ref: [Popenoe p.p 218-19]। আধুনিক সমাজে ব্যক্তির কোন গুণাবলিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে সেটা নির্ভর করে সমাজের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বা সমাজের উপর। অনেকে সম্পদ ক্ষমতা এবং খ্যাতিকে এককথায় সমাজের পুরস্কার হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এগুলোকে আধুনিক সমাজে দুর্লভ এবং মূল্যবান কাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তু মনে করে। তবে Devid Popenol ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন, এগুলোকে পুরস্কার বলা ঠিক নয়। কারণ এতে মনে হতে পারে, যারা ঐসব বিষয়বস্তু অর্জন করেছে তারা এমন কিছু করেছে, যার ফলে তারা এগুলো অর্জনের দাবি বা যোগ্যতা রাখে। তিনি বলেছেন, ধনী গৃহের সন্তান জন্মসূত্রেই
সম্পদ লাভ করে, তাকে কিছুই করতে হয় না। আর ক্ষমতা ব্যবহারের উপযুক্ত বয়স হলেই তারা ক্ষমতার অধিকারীও হয়। তাই পোপেনো বলেছেন, কেউ নিজ চেষ্টা দ্বারা কাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তু অর্জন করে। কেউবা সমাজে ভালো অবস্থানে থাকার জন্য অর্থাৎ, জন্ম সূত্রেই কাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তু পেয়ে যায়। এজন্য সমাজবিজ্ঞানীরা যেসব দুর্লভ মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বিষয়বস্তুকে Reward বলতে চেয়েছেন। পোপেনো তাকেই কাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তু বা Desirables বলতে চেয়েছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক অসমতার প্রকৃতি আলোচনা থেকে আমরা এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এ বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক একটি বিষয় এবং এটি সমাজের প্রয়োজনেই সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট। পৃথিবীর সকল সমাজেই এ অসমতা পরিলক্ষিত হয়।