অথবা, সামাজিক বৈষম্যের জন্য দায়ী উপাদানগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, সামাজিক বৈষম্যের কারণগুলো বর্ণনা কর।
অথবা, কেন সামাজিক অসমতা দেখা দেয়? আলোচনা কর।
অথবা, সামাজিক অসমতার জন্য দায়ী উপাদানগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক অসমতা বা বৈষম্য (Social inequality) সমাজজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যা অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও সমাজব্যবস্থার মাঝে বিদ্যমান রয়েছে। সামাজিক বৈষম্যের ধারণাটি সামাজিক স্তরবিন্যাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত সামাজিক স্তরবিন্যাসের ফলশ্রুতি হলো সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা। সম্পত্তি, ক্ষমতা ও মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্পরিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজতত্ত্বের আলোচনায় এ পার্থক্যের ধারণাকেই সামাজিক বৈষম্য হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়।
সামাজিক অসমতা বা বৈষম্যের কারণসমূহ : সমাজে অসমতা, বা বৈষম্য প্রাচীনকাল হতেই চলে এসেছে। সামাজিক বৈষম্য প্রধানত সমাজব্যবস্থারই অনিবার্য ফল। এ বৈষম্য বা অসমতার পিছনে অনেক কারণ বিরাজমান । সামাজিক বৈষম্য বা অসমতার কারণ সম্বন্ধে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. বয়সভেদে সামাজিক বৈষম্য বা অসমতা (Social inequality by age) : সমাজে ছোটদের চেয়ে বড়দের অধিক মূল্যায়ন করা হয় এবং বড়রা তুলনামূলকভাবে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। বয়োজ্যেষ্ঠরা সম্মান এবং শ্রদ্ধার পাত্র অর্থাৎ ছোটরা বড়দেরকে সম্মান করবে, তাদের ভালো উপদেশ, সুন্দর পরামর্শ মেনে চলবে, বড়দের মনে কষ্ট দেবে না এবং
তাদের কথা অমান্য করবে না- এটাই সমাজের স্বাভাবিক রীতি। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার বড়দের উপর অর্পণ করা হয় এবং যে কাজে অধিক শক্তির প্রয়োজন হয় সে কাজ যুবক বা তরুণদের দ্বারা করানো হয়ে থাকে। সমাজে বয়সভেদে অসমতা বা বৈষম্যের ধরন এরূপই।
২. নারী-পুরুষ তথা লিঙ্গভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by gender) : সেই আদিযুগ হতেই সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদেরকে অবমূল্যায়ন করার রীতি চালু হয়ে আসছে। সমাজে বিভিন্নভাবে নারীর উপর অবিচার করা হয় এবং নারীর অধিকার ও অবদানকে স্বীকার করা হয় না। সমাজের নেতৃত্ব দেওয়া, সমাজ পরিচালনা করা, বাড়ির বাইরের যে কোনো কাজ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে পুরুষদেরকে নিয়োজিত করা হয়। পক্ষান্তরে, নারীদেরকে নিয়োজিত করা হয় সন্তান লালনপালন, বাড়ির আশেপাশের হালকা কাজ, বাড়ির ভিতরের গৃহস্থালির কাজকর্ম ইত্যাদির মাঝে। অর্থনৈতিকভাবেও তাদেরকে অবজ্ঞা করা হয়। সামাজিক রীতি এমন যে নারীরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল হবে, পুরুষেরা নারীর রক্ষক ও অভিভাবক। এভাবে সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রতি বিভিন্নভাবে বৈষম্য করা হয়। এ বৈষম্যের পিছনে কাজ করে সমাজ-সংস্কৃতির নিয়মরীতি, প্রথা, ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, সমাজে নারীদেরকে বিভিন্ন দিক দিয়ে অবমূল্যায়ন করার রীতিই নারীর প্রতি বৈষম্যের অন্যতম প্রধান কারণ।
৩. বংশ মর্যাদাভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by rank) : বংশ মর্যাদাভেদে সামাজিক অসমতার দৃষ্টান্ত অহরহই দেখা যায়। আদিম সমাজেও এটা যেমন ছিল বর্তমান সমাজেও তেমনি রয়েছে। যারা উচ্চ বংশে (যেমন : রাজ পরিবার, জমিদার পরিবার, প্রধানদের পরিবার ইত্যাদি) জন্মগ্রহণ করে তারা নিম্ন বা সাধারণ বংশে জন্মগ্রহণকারী লোকজন অপেক্ষা সমাজে অধিক মান-মর্যাদা এবং সুযোগ সুবিধার অধিকারী হয়।
৪. জাতি-বর্ণভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by caste) : প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সমাজে তীব্র জাতি-বর্ণ প্রথা প্রচলিত ছিল। এখনও ভারতের অনেক সমাজে এ প্রথা চালু আছে। তবে এখন এ প্রথা অনেকটা নমনীয় আকার ধারণ করেছে। প্রাচীন হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এ চারটি বর্ণে বিভক্ত ছিল। এর পাশাপাশি আরেকটি বর্ণ ছিল যার নাম ছিল অস্পৃশ্য। সামাজিক অবস্থান এবং মান-মর্যাদার দিক দিয়
ে ব্রাহ্মণরা ছিল সবচেয়ে ঊর্ধ্বে, এরপরে ক্ষত্রিয়, এরপরে বৈশ্য ও তারপরে ছিল শূদ্রদের অবস্থান। সবচেয়ে নিম্নস্তরে ছিল অস্পৃশ্যরা। সমাজে প্রত্যেক বর্ণের কাজকর্ম ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের কাজ করতে পারত না। সমাজে সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করত ব্রাহ্মণ বর্ণের লোকেরা। তাদের জন্য পৃথক রাস্তাঘাট, দোকান, হাসপাতাল অফিস এবং অন্যান্য ব্যবস্থা ছিল।
৫. নরগোষ্ঠীভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by race) : পৃথিবীর অনেক সমাজ ব্যবস্থাতেই নরগোষ্ঠীভেদে সামাজিক অসমতা প্রতীয়মান হয়। বিশেষকরে আমেরিকা, ব্রিটেন এবং আফ্রিকান সমাজে এ ধরনের বৈষম্য বেশি দেখা যায়। এ অসমতা মূলত শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ দৃষ্টিকোণ থেকে হয়ে থাকে। শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের উপর
আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং নেতৃত্বের ভূমিকা সর্বক্ষেত্রেই পালন করতে চায়। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বিভিন্ন দিক দিয়ে বঞ্চিত ও ঈর্ষা করা হয়। যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে শ্বেতাঙ্গরা। এরূপ বৈষম্য থেকেই সৃষ্টি হয় শ্বেতাঙ্গ- কৃষ্ণাঙ্গ দ্বন্দ্ব। এ একই ধরনের বৈষম্য দেখা যায় আমেরিকান নিগ্রো ও ককেশয়েডদের মাঝে। নরগোষ্ঠীভেদে সামাজিক অসমতার মূল কারণ এক গোষ্ঠীর প্রতি অন্য গোষ্ঠীর ঈর্ষাবোধ।
৬. স্বেচ্ছাসেবী সংঘের সদস্যপদ এবং সামাজিক অসমতা (Membership in voluntary association and social inequality) : বিভিন্ন পেশার কিংবা একই পেশার লোক অনেক সময় এক বা একাধিক উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংঘ গড়ে তোলে। আবার কেউবা দাতব্য সংস্থা গঠন করে যার উদ্দেশ্য থাকে জনকল্যাণ । সবাই এসব সংস্থার সদস্য হতে পারে না। যারা এর সদস্য হয় তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সাথে মেশার মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। এর মাধ্যমে অনেকে বিনোদনের উপায়ও খুঁজে পায়। কিন্তু যারা এসব সংঘের সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয় তারা উল্লিখিত সুবিধা ভোগ করতে পারে না। এভাবেও সামাজিক অসমতার সৃষ্টি হয় ।
৭. শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by class) : সমাজের মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত। এ শ্রেণিবিন্যাস ক্ষমতা, সম্পত্তির মালিকানা, প্রতিপত্তি, পদমর্যাদা, সামাজিক অবস্থান, ধনী-দরিদ্র ইত্যাদির ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। সমাজে যারা উচ্চ শ্রেণির লোক তারা নিম্ন শ্রেণির লোকজন অপেক্ষা অধিক সুবিধা লাভ করে। সমাজে শ্রেণিবিন্যাস ধারণার মূল প্রবক্তা হলেন কার্ল মার্কস। তিনি সমাজকে মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এদের একটি হলো বুর্জোয়া শ্রেণি যারা উৎপাদন যন্ত্রের মালিক এবং অপরটি হলো সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণি। তবে এ দুটি শ্রেণি ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি শ্রেণির কথা বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ মধ্যবিত্ত শ্রেণি, কৃষক শ্রেণি ইত্যাদি। এরূপ শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজে বুর্জোয়াই যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং তাদের হাতেই সম্পদ কুক্ষিগত থাকে । পক্ষান্তরে, সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণি শ্রম অনুযায়ী তার ফল ভোগ করতে পারে না। এদেরকে সর্বদিক দিয়েই বঞ্চিত ও শোষণ করা হয়। আবার সমাজে উচ্চ শ্রেণির লোকেরা নিম্ন শ্রেণির লোকদের চেয়ে অধিক সুবিধা ভোগ করে। এরূপভাবে শ্রেণিভেদে সামাজিক অসমতা প্রতীয়মান হয়ে থাকে।
৮. সামাজিক ভূমিকাভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by social role) : সমাজে অনেক লোক আছে যারা উচ্চবিত্ত, ধনী বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য নয়; এরা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। এ ধরনের লোক নানা ধরনের উন্নয়নমূলক ও জনসেবামূলক কাজ করে সমাজে পরিচিত হয়ে ওঠে। তাদের এ ধরনের ভূমিকা ও কাজকর্মের জন্য তারা সমাজে সবার প্রিয়পাত্র তথা মর্যাদাধারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। কিন্তু অনেকে তা পারে না। ফলে এ দৃষ্টিকোণ থেকেও সামাজিক অসমতার সৃষ্টি হয়।
৯. ক্ষমতাভেদে সামাজিক অসমতা (Social inequality by power) : অসম ক্ষমতা হলো
সামাজিক অসমতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। সমাজে সব মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা, সামর্থ্য, যোগ্যতা তথা সামাজিক অবস্থান একরূপ নয়। ফলে তাদের ক্ষমতাও বিভিন্নরূপ হয়ে থাকে। সাধারণভাবে দেখা যায়, সমাজে উচ্চ শ্রেণির মানুষের ক্ষমতা নিম্ন শ্রেণির মানুষের চেয়ে অনেক বেশি হয়। ফলে উচ্চ শ্রেণির লোকেরা অধিক মর্যাদাধারী হয়। আবার ক্ষুদ্র সংগঠনের নেতা অপেক্ষা বৃহৎ সংগঠনের নেতা এবং বিরোধী দলের নেতার চেয়ে সরকারি দলের নেতার ক্ষমতা অধিক হয়। ফলশ্রুতিতে তারা সমাজে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে থাকে। ক্ষমতাভেদে এভাবে সমাজে অসমতা বা বৈষম্যের সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, সমাজব্যবস্থার একটি অতি সাধারণ চিত্র হলো সামাজিক অসমতা। এ অসমতা বা বৈষম্য প্রাচীন সমাজেও ছিল এবং বর্তমান সমাজেও বিরাজমান। সামাজিক অসমতার পিছনে জৈবিক এবং সামাজিক উভয় ধরনের কারণই বিদ্যমান। এ কারণে পৃথিবীর সব সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার মাঝেই সামাজিক অসমতা অনিবার্যভাবে প্রতীয়মান হয় ।