সামাজিকীকরণ কী?

অথবা, সামাজিকীকরণ বলতে কী বুঝ?
অথবা, সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা দাও।
অথবা, সামাজিকীকরণ কাকে বলে?
উত্তর৷ ভূমিকা :
সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশুর জন্মের পর থেকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ‘চলতে থাকে। এটা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কোনো ফল নয়। এটা মানুষকে অর্জন করতে হয়। মানুষ যখন জন্মলাভ করে, তখন তার মধ্যে সমাজ ও সংস্কৃতি বলে কোনো চেতনা থাকে না। ক্রমান্বয়ে শিশু সমাজস্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের দ্বারা শিশুর মানসিকতা গড়ে উঠে এবং তার ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। সমাজের সাথে ব্যক্তির এ অভিযোজন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রক্রিয়াই সামাজিকীকরণ হিসেবে পরিচিত। বহু দল ও প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখে। এগুলোকে বলা হয় সামাজিকীকরণের মাধ্যম। ব্যক্তির সামাজিকীকরণের মাধ্যমগুলোর মধ্যে পরিবার ও ধর্মের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিকীকরণ : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাদের কয়েকজনের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (MacIver) এর মতে, “সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমনই একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুরা সামাজিক জীবনে অন্যদের সাথে বৃহত্তর ও গভীরতর সম্পর্ক গড়ে তোলে, সেখানে তারা তাদের নিজের এবং অন্যের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। আর এভাবে নিকটবর্তী ও বৃহত্তর সংঘের জটিল কাঠামোর বিকাশ ঘটে।”
কিমবল ইয়ং (Kimball Young) সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “সামাজিকীকরণ বলতে একজন ব্যক্তিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে অধিষ্ঠিত করাকে বুঝায়। এর মাধ্যমে সে সমাজ ও অন্যান্য গোষ্ঠীর সদস্যপদ অর্জন করে এবং সে যে সমাজে জন্মগ্রহণ করে সে সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শ আয়ত্ত করে। সামাজিকীকরণ সুনির্দিষ্টভাবেই একটি শিক্ষণীয় বিষয়। এটি মোটেই জৈবিক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত নয়।” সমাজবিজ্ঞানী বোগারডাস (Bogardus) বলেছেন, “এ হলো সে প্রক্রিয়া যার ফলে ব্যক্তি জনকল্যাণের জন্য আচরণ করতে শিখে এবং তা করতে গিয়ে সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করে।” গিলীন ও গিলীন (Gllin & Gllin) সামাজিকীকরণের সংজ্ঞায় বলেছেন, “সামাজিকীকরণ বলতে আমরা এমন একটি প্রক্রিয়াকে বুঝি, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার মূল্যবোধ, মানদণ্ড ও ঐতিহ্য অনুসারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এভাবে সে নিজেকে সামাজিক অবস্থার সাথে খাপখাইয়ে নেয়।” লান্ডবার্গ (Lundberg) বলেছেন, “সামাজিকীকরণ মিথস্ক্রিয়ার একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি অভ্যাস, দক্ষতা, আস্থা বিশ্বাস, বিচারবুদ্ধি অর্জন করে, যেগুলো সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অপরিহার্য।” আরনল্ড গ্রীন (Arnold Green) এর মতে, “সামাজিকীকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি শিশু আপন সংস্কৃতির সাথে সুপরিচিত হয় এবং এভাবে তার অহংবোধ ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে।”
উপসংহার : উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, সামাজিকীকরণ হলো সে প্রক্রিয়া; যার মাধ্যমে মানবশিশু সামাজিক মূল্যবোধ, আদর্শ, আচরণ, নিয়মনীতি শিক্ষালাভ করে নিজেকে সমাজে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলে এবং যা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তির সারাজীবন ধরে চলতে থাকে।