সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের ভূমিকা আলোচনা কর।

মাধ্যম হিসেবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাহনের ভূমিকা আলোচনা
জিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের অবদান আলোচনা
অথবা, সামাজিকীকরণের কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
সামাজিকীকরণ জন্মসূত্রে প্রাপ্ত কোনো ফল নয়। এটা মানুষকে অর্জন করতে হয়। মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার সমাজ ও সংস্কৃতি বলে কিছুই থাকে না। আস্তে আস্তে শিশু সমাজস্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের দ্বারা শিশুর মন মানসিকতা গড়ে উঠে। বহু Group এবং Institution ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এগুলোকে বলা হয় সামাজিকীকরণের মাধ্যম। এ মাধ্যমগুলো একটি আরেকটির পরিপূরক এবং সহযোগী। কর।
১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : গৃহ পরিবেশে অর্জিত জ্ঞান ও মনোভাব নিয়ে শিশু প্রবেশ করে বৃহত্তর সামাজিক পরিমণ্ডলে। এ বৃহত্তম পরিমণ্ডলের প্রথম ধাপ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে তিনভাবে শিশুর সামাজিকীকরণ হয় শিক্ষক, বই-পুস্তক ও সহপাঠীর দ্বারা। শিশু যখন প্রথম বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে তার দীক্ষিতকরণ শুরু হয়। এখানে ক্রমে শিশু শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক ও সহপাঠীর সান্নিধ্য লাভ করে এবং এদের প্রভাব পড়ে শিশুর উপর। এখানে এসে শিশু শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যাই অর্জন করে না। এর পাশাপাশি শিক্ষক ও বিভিন্ন পরিবার ও সংস্কৃতির এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে স্বীয় সমাজের মূল্যবোধ আদর্শ এবং সমাজ স্বীকৃত আচার-আচরণসমূহ একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারা আয়ত্ত করে। এ শিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দ্রুত উন্নত হয়। পরিবারে শিশু সব সময়ই কিছু পাবার আশা করে কিন্তু এখানে এসে শিশু যেমন নিতে শেখে তেমনি দিতে শেখে যা তাকে বৃহত্তর পরিবেশে খাপখাইয়ে নিতে সাহায্য করে। বিদ্যালয়ে এসে শিশুর মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে উঠে এবং নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলার সুন্দর অভ্যাসটি শিশু এখান থেকে রপ্ত করে এবং শিশুর মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার মাধ্যমে শিশু সামাজিকীকরণের শিক্ষা পায়। আধুনিককালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সামাজিকীকরণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান : মানবসমাজে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সমগ্র জীবনধারা জুড়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাব প্রতিক্রিয়া প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। পরিবারের মাতাপিতার বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন এবং সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন ধ্যানধারণা, আদর্শ ও বিশ্বাসে ধর্মের প্রভাব দেখে শিশু সামাজিকীকরণের শিক্ষা পায়। ধর্ম নির্দেশিত পন্থায় জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষ অন্যায়, অত্যাচার, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা ইত্যাদি বর্জন করে সহজ সরল জীবন সম্পর্কে প্রবৃত্ত হয়। আর এভাবেই সামাজিক সম্পর্ক উন্নত হয়।
৩. বিবাহ : যখন ব্যক্তি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন সে ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রে এক নয়া রদবদল ও পরিবর্তন ধারার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। যে দু’টি পরিবারের মধ্যে বিবাহ হয় সে দু’টি পরিবারের অভ্যাস, ভাবধারা, আচার আচরণ ভিন্ন হতে পারে। আর এ ধরনের দু’টি পরিবার পরস্পর পরস্পরের সাথে খাপখাওয়াতে পারলে সামাজিকীকরণের আরেকটি পর্ব সম্পাদিত হয়। বিবাহের পর যথাযথ নিয়মে সন্তান হয়। তখন ব্যক্তিকে নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মাতাপিতা হিসেবে তাকে আবার পরিবারের সাথে খাপখাওয়াতে হয়। সুতরাং বলা যায়, বিবাহ ব্যক্তির সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজন : পরিবারের পরেই শিশু নিকট প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের সাথে মিশতে শুরু করে। তাদের কার্যকলা প, কথাবার্তা, আচারব্যবহার, সংস্কৃতি বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করতে থাকে যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে । সুতরাং, ব্যক্তির সামাজিকীকরণে প্রতিবেশীর ভূমিকা কম নয়।
৫. গণমাধ্যম : বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার ফলে প্রচার মাধ্যমগুলো বিশেষ করে টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা এবং এর সাথে পত্রপত্রিকা বা সাময়িকীসমূহ আমাদের সামাজিক জীবনে বিশেষ করে ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। তবে এর মধ্যে দূরদর্শনের ভূমিকা সর্বাধিক। এ গণমাধ্যমগুলোতে ঐ সমাজের বিভিন্ন আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। বিশেষ করে সমাজের পরিবর্তিত মূল্যবোধ ও মনোভাবগুলোর প্রকাশ পায় যা ব্যক্তির সামাজিকীকরণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলো বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে ব্যক্তির পরিচয় ঘটায়। বিভিন্ন প্রকার শিক্ষামূলক, বিনোদনমূলক ও সমাজসেবামূলক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় যার দ্বারা ব্যক্তি প্রভাবিত হয় এবং ব্যক্তি বিভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে শেখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার ৩-১৬ বছর বয়সীরা বিদ্যালয়ের চেয়ে টেলিভিশনের সামনেই বেশি সময় কাটায়। টেলিভিশনের যে প্রভাব শিশুর প্রতি তাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
৬. রাষ্ট্র : রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী সংগঠন। এটি আইন তৈরি করে এবং আশা করে যে সবাই যেন আইন পালন করে। সকলকে বাধ্যতামূলক আইন মানতে হয়। কেউ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তার জন্য রয়েছে শাস্তি। এভাবেই রাষ্ট্র ব্যক্তির আচরণে প্রভাব ফেলে।
৭. বই-ম্যাগাজিন : যারা লিখতে ও পড়তে পারে তাদের সামাজিকীকরণে পুস্তক এবং সাময়িক পত্রপত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের চিন্তার জগৎ অর্থাৎ, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং ভাবাদর্শ নানা রকমের সংস্কার এবং বিশ্বাস ছাপার অক্ষরে প্রতিবিম্বিত হয়। কাজেই নানা রকমের পুস্তক ও পত্রপত্রিকা আমাদেরকে সমাজে প্রচলিত ধ্যানধারণার সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, সামাজিকীকরণ হচ্ছে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সমাজের বাইরে এটি সম্ভব নয়। বলা যায়, সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া। পারিবারিক জীবনে মাতাপিতা ও ভাইবোন থেকে শুরু করে সমাজজীবনের প্রতিটি স্তরে এসে বিভিন্ন Media এর মাধ্যমে ব্যক্তির সামাজিকীকরণ হয়। আত্মীয়স্বজন ছাড়া প্রতিবেশী, খেলার সাথি, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, সহপাঠী, বইপুস্তক, রেডিও, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ইত্যাদির সবকিছু ব্যক্তির সামাজিকীকরণে সাহায্য করে থাকে। এজন্য বলা হয় সামাজিকীকরণ সমাজের প্রতিটি অবয়বের সঙ্গে যুক্ত।