সাক্ষাৎকারের কৌশলসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, সাক্ষাৎকারের কৌশলসমূহ কী কী?
অথবা, সাক্ষাৎকারের উপায়সমূহ লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাক্ষাৎকারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মনোসামাজিক অনুধ্যান করত তার সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা।এজন্য সমাজকর্মীকে সাহায্যার্থী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহ করতে হয়।
তথ্যসংগ্রহপূর্বক ব্যক্তির মনোসামাজিক অবস্থা অনুধ্যান করতে হলে সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে কতিপয় কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এ্যানেট গ্যারেট (Annet Garet) সাক্ষাৎকারের কতকগুলো কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- পর্যবেক্ষণ, শ্রবণ, প্রশ্ন করার কৌশল, প্রশ্নের উত্তরদান, পরিচালনা ও ব্যাখ্যা দান।
সাক্ষাৎকারের কৌশল : নিম্নে সাক্ষাৎকারের কৌশল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. গ্ৰহণ (Acceptance) : সাক্ষাৎকারের প্রথম ও প্রধান কৌশল হলো সমাজকর্মী কর্তৃক ব্যক্তিকে সুন্দর,ও সাদরে গ্রহণ করা। সমাজকর্মীর নিকট ব্যক্তি তার সমস্যা সমাধানের জন্য আগমন এবং সমাজকর্মীর নিকট ভালো আচরণ প্রত্যাশা করে। তাই ব্যক্তির সাথে সমাজকর্মীকে ভালো আচরণ প্রদর্শন এবং প্রথম সাক্ষাৎকারেই তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে হয়। ব্যক্তিকে সমাজকর্মী আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলে পেশাগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সহজ এবং উভয়ের মধ্যে আলোচনা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্যক্তি সমাজকর্মীকে একজন ভালো গাইড ও
পরামর্শদাতা বলে মনে করে তার সমস্যা সমাজকর্মীকে অকপটে বলার সাহস পায়। ব্যক্তি সমাজকর্মীর নিকট তার সমস্যার কথা বলতে পারলে তার মনের ভিতর জমে থাকা কষ্ট, যাতনা অনেকটা লাঘব হয়।
২. পর্যবেক্ষণ (Observation) : কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোনকিছুকে মনোযোগসহকারে প্রত্যক্ষ করাকে পর্যবেক্ষণ বলে।এটাও সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সমাজকর্মী পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির অনেক না বলা কথা উদ্ধার করতে পারেন। পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মুখমণ্ডলের প্রকাশভঙ্গি, রাগ, বিমর্ষতার ছাপ,উৎফুল্লতা, আবেগ, অনুভূতির ধরন ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়, যা সমাজকর্মীকে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে অনেক সহায়তা করে। অন্যদিকে, “সাহায্যার্থী যা ব্যক্ত করে অথবা যা করতে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অক্ষম তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমাজকর্মী মোটামোটিভাবে ‘ধারণা’ নিতে পারেন। ব্যক্তির প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, অর্ধপ্রকাশিত বক্তব্য বা কাহিনীর মধ্যে প্রায় সকল শূন্যতা, অসংলগ্নতা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ কৌশল কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সমস্যাগ্রস্ত সাহায্যার্থী যা অনুভব করে তা প্রকাশ করতে পারে না। তার বক্তব্যে বলাবাহুল্য কিছু কিছু ফাঁক বা শূন্যতা থাকা স্বাভাবিক।” এই শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষণ কৌশল কাজে লাগে।
৩. শ্রবণ (Listening) : সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিকে ভালোভাবে জানা ও বুঝা। আর ব্যক্তিকে ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হলে অবশ্যই তার কথা গভীর মনোযোগ ও ধৈর্যসহকারে শ্রবণ করতে হবে।এটা সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সমাজকর্মী যদি ব্যক্তির কথা ভালোভাবে শ্রবণ না করেন, তাহলে ব্যক্তি তার মনের যাতনা, মনের গভীরে জমিয়ে রাখা কথা খোলাখুলিভাবে সমাজকর্মীকে বলতে পারবে না। আর ব্যক্তি যদি তা বলতে না পারে তাহলে তার সম্পর্কে তথ্য জানাও সম্ভব হবে না। এ কারণে ব্যক্তিকে কথা বলার সুযোগ প্রদান এবং এ উদ্দেশ্যেই তার কথা শ্রবণ করতে হবে। ড. আবদুল হাকিম সরকার বলেন, “সমাজকর্মীকে প্রধান প্রবণকারীর ভূমিকা নিতে হয়।ব্যক্তিকে তার যা বলার সুযোগ দিয়ে এক্ষেত্রে এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, একজন দক্ষ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ভালো শ্রবণকারীও বটে। সাহায্যার্থীর বক্তব্য শ্রবণের ব্যাপারে সমাজকর্মী পরোক্ষ এক প্রবণশক্তি দ্বারা অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ দ্বারা তার অপ্রকাশিত বা অর্ধপ্রকাশিত তথ্য তথ্য সার্বিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে থাকেন। মনে রাখা প্রয়োজন শ্রবণ বলতে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন বুঝায় না। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে যে কৌশল অবলম্বন করতে হয় তা হলো।
ক. পেশাগত আলাপচারিতার অতিরিক্ত কথা না বলা।
খ. একেবারে নীরবতা পালন না করা;
গ. বক্তব্য শোনার মাঝে মাঝে কথা বলা;
ঘ. গভীর আগ্রহের সাথে বক্তব্য শুনে তা উপলব্ধি করা;
ঙ. শ্রবণের পাশাপাশি মন্তব্যধর্মী বক্তব্য রাখা ও
চ. সাহায্যার্থীকে তার সমস্যা সংক্রান্ত কাহিনী প্রকাশ করতে অবাধ সুযোগ প্রদান।
৪. প্রশ্নকরণ (Questioning) : সমাজকর্মী ব্যক্তির কথাবার্তা যেমন শ্রবণ করবেন তেমনি শ্রবণের ফাঁকে ফাঁকে কিছু প্রশ্নও করবেন। কারণ প্রশ্ন করলে একদিকে ব্যক্তি যেমন মনে করবে যে সমাজকর্মী তার কথাগুলো ভালোভাবে শুনছেন; তেমনি ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু তথ্য বের করাও সম্ভব হবে। প্রশ্নকরণের ক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে কিছু কৌশলী হতে হয়। যেমন-
ক. প্রশ্ন করার মধ্যে সমাজকর্মীর দৃষ্টিভঙ্গি, অনুভূতি ও সাহায্য করার ইচ্ছার কথা ব্যক্তিকে বুঝানোর চেষ্টা করা;
খ. এমন কোন প্রশ্ন করা যাবে না, যাতে ব্যক্তি নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাবতে পারে;
গ. প্রশ্নকরণের ক্ষেত্রে সুমধুর সুর ও চমৎকার প্রকাশভঙ্গির অভিব্যক্তি থাকবে;
ঘ. প্রশ্নকরণের মাধ্যমে যাতে ব্যক্তিকে জানা ও তার সমস্যাকে চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারে;
ড. প্রশ্নের মাধ্যমে যাতে ফলপ্রসূ আলোচনার পথ সুগম হয়;
চ. প্রশ্ন হবে ব্যক্তির জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ও পরিচালনামূলক;
ছ. প্রশ্নের উত্তর যাতে ‘হ্যাঁ বা না’তে সীমাবদ্ধ না থাকে এবং
জ. প্রশ্ন যেন ব্যক্তিকে নিরুৎসাহিত না করে।
৫. কথা বলার পূর্বে শ্রবণ (Listening before talking) : কথা বলার পূর্বে শ্রবণ করা সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সমাজকর্মী ব্যক্তিকে প্রাণ খুলে কথা বলার সুযোগ দিতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে কতকগুলো বিশেষ দিক খেয়াল করতে হবে। যেমন-
ক. ব্যক্তি যে কোন কথা বলতে চাইলে সমাজকর্মীকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে;
খ. সমাজকর্মীর বেশি কথা বলা যাবে না;
গ. ব্যক্তি বেশি কথা বললে তাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না।এছাড়া সমাজকর্মীকে ব্যক্তির কথা এমনভাবে শ্রবণ করতে হবে যাতে ব্যক্তি কথা বলতে উৎসাহী হয়।
৬. কথা বলা (Talking) : সমাজকর্মীকে সবসময় সাহায্যার্থী ব্যক্তির সাথে আন্তরিকতার সাথে কথা বলতে হবে।সাহায্যার্থীর প্রশ্নের উত্তর দান ও সমস্যা সম্পর্কেও তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে কথাগুলো যাতে সাহায্যার্থীর কাছে শ্রুতিমধুর হয়। সমাজকর্মী যে কথা বলবেন তা যেন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববোধে আঘাত না করে।
৭. ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব দান (Answering personal questions) : ব্যক্তি পেশাদার সমাজকর্মীকে খুব ঘনিষ্ঠজন মনে করে এবং সমাজকর্মীর সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিগত প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে পারেন।
অনেক সময় ব্যক্তি এমন প্রশ্নও করতে পারে যা সমাজকর্মীর নিকট বিব্রতকর। এরূপ পরিস্থিতিতে সমাজকর্মীকে খুব সচেতনভাবে ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী খুব সুন্দর অথচ সহজ ও সংক্ষিপ্তাকারে উত্তরদানে সচেষ্ট
থাকবেন। সমাজকর্মীকে এক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে এ উত্তর প্রদানের মাধ্যমে যেন পেশাগত সম্পর্কের দিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সমাজকর্মীকে এক্ষেত্রে কিছু কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। যেমন-
ক. পরিচিতিমূলক সাক্ষাতেই উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে সমাজকর্মীকে তার পরিচয় তুলে ধরতে হবে;
খ. সরাসরি নিজের কথা না বলে অন্যের উদাহরণ টেনেও ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা যেতে পারে;
গ. ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়কে আগ্রহী করে তোলার জন্য তার কিছু গুণের প্রশংসা করা;
ঘ. পেশাগত স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে প্রশ্নের জবাব দান;
ঙ. কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুকৌশলে ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়া।
৮. নেতৃত্ব বা পরিচালনা (Leadership or Direction) : সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক বিষয়ে সমাজকর্মীকে নেতৃত্ব বা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী যেসব কৌশলের আশ্রয় নিবেন তা হলো :
ক. সমাজকর্মী প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি খেয়াল রেখে আলোচনার গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করবেন;
খ. কি ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন তা সমাজকর্মী নির্ধারণে সচেষ্ট হবেন;
গ. প্রয়োজনে সমাজকর্মী ব্যক্তিকে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করবেন এবং
ঘ. ব্যক্তির অপ্রাসঙ্গিক ও অতিরিক্ত কথা বলা নিয়ন্ত্রণের জন্য তাকে সরাসরি প্রশ্ন করবেন।
৯. বিশদ ব্যাখ্যা (Interpretation) : সাক্ষাৎকারে ব্যক্তি সব কথা বুঝতে সক্ষম নাও হতে পারেন। অনেক সময় সমাজকর্মীর প্রশ্নও ব্যক্তি বুঝতে পারে না। এক্ষেত্রে সমাজকর্মী ব্যক্তিকে সবকিছু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিবেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে ব্যক্তির সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্কও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। আবার ব্যক্তিকে সামঞ্জস্য বিধানে যে পরিবর্তিত আচরণ করতে হবে তা ব্যক্তি নাও বুঝতে পারে। এটাও একজন পেশাদার সমাজকর্মী ব্যক্তিকে বিশদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। “সমস্যার গভীরে প্রোথিত যে সমস্ত উৎস, উপলক্ষ্য বা চূড়ান্ত অবস্থা দায়ী বলে প্রতীয়মান হয় সেগুলো ব্যাপকভাবে উপলব্ধির জন্য পর্যাপ্ত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। সমাজকর্মী সর্বদাই ব্যক্তির মন্তব্যের গভীরে প্রবেশ করে আসল সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। প্রধান প্রধান উপলক্ষ্য ও কারণসমূহের উপর ভিত্তি করে সমাজকর্মী ক্রমাগতভাবে সমস্যা সম্পর্কে কার্যকরী অনুম গঠন করে থাকেন এবং ধাপে ধাপে তা পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেন।এই পরীক্ষানিরীক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু বর্জন, মোটামুটি প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত বিষয়সমূহ ধারণ এবং প্রয়োজনে আরো নতুন তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার অবতারণা ঘটানোই উক্ত কৌশলের কাজ। উল্লেখ করা যায় যে, সমস্ত ঘটনা সুষ্ঠুভাবে বুঝার ব্যাপারে সমাজকর্মীর জন্যই এই ব্যাখ্যার প্রয়োজন বেশি।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি, সাক্ষাৎকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ করার জন্য সমাজকর্মীকে সাক্ষাৎকারকালে কতকগুলো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। উপরোল্লিখিত এসব কৌশল একজন সমাজকর্মীর সাথে একজন ব্যক্তির পেশাদার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় যেমন সাহায্য করে তেমনি ব্যক্তির সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারপূর্বক সে সমস্যার সঠিক সমাধান প্রদানেও সাহায্য করে।সাক্ষাতের কৌশলের উপর পেশাগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন অনেকটা নির্ভর করে।