সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্বগুলো কী কী?

অর্থবী, সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্ব উল্লেখ কর।
অথবা, সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্বসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্বসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
সমাজকর্ম পেশার কতকগুলো নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে।আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এসব মানদগুগুলো অনুসরণ করেই সমাজকর্মীদেরকে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। National Association Social Worker (NASW) ১৯৯৯ সালে সমাজকর্মের ৬টি নৈতিক মানদণ্ড (Ethical Standards) নির্ধারণ করেছে।এর মধ্যে একটি হলো সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্ব।
সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্ব
১৯৯৯ সালে আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি সমাজকর্মের সংশোধিত নৈতিক মানদণ্ড তৈরি করে। এই মানদণ্ড অনুযায়ী সহকর্মীর প্রতি সমাজকর্মীর নৈতিক দায়িত্ব নিম্নরূপ :
১. শ্রদ্ধা (Respects) : সমাজকর্মী তার সহকর্মীর প্রতি শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, আনুগত্য ইত্যাদির কারণে শ্রদ্ধাপোষণ করবেন। তাছাড়া সমাজকর্মী অহেতুক সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকবেন।সহকর্মীর ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা, জাতীয়তা, লিঙ্গ পরিচয়, বয়স, বৈবাহিক মর্যাদা, রাজনৈতিক দর্শন এবং মানসিক ও শারীরিক কারণে বিরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবেন। বরং সমাজকর্মী তার সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।
২. গোপনীয়তা (Confidentiality) : পেশাগত কারণে সমাজকর্মীগণ একে অপরের নিকট থেকে তথ্য, দলিল দস্তাবেজ, নথি ইত্যাদি আদান-প্রদান করতে পারেন। এসব বিষয় পেশাগত কারণেই পুরোপুরি গোপন রাখতে হবে।
৩. আজ্ঞডিসিপ্লিনারি সমন্বয় (Interdiciplinary collaboration) : সমাজকর্মীরা আন্তঃডিসিপ্লিনারি কমিটির
সদস্য হিসেবেও কাজ করেন। আন্তঃডিসিপ্লিনারি কমিটির সদস্য হলেও সমাজকর্মীকে তার ক্লায়েন্টকে সাহায্য করতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। সমাজকর্মীকে সমাজকর্মের মূল্যবোধের সাথে অন্যান্য বিষয়ের মূল্যবোধেরও সমন্বয়সাধন করতে হয়।
৪. সহকর্মী সংশ্লিষ্ট বিতর্ক (Dispute involving colleague) : সমাজকর্মী তার নিজের স্বার্থের কারণে অযথা সহকর্মী ও কর্মচারীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করবেন না। তাছাড়া সাহায্যার্থীদের সম্মুখে তারা তাদের সহকর্মীদের সম্পর্কে কোনো বিতর্কিত আলোচনাও করতে পারবেন না।
৫. উপদেশ/পরামর্শ (Consultation) : সমাজকর্মী তার ক্লায়েন্টকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে প্রয়োজনবোধে তার সহকর্মীর পরামর্শ নিবেন। সহকর্মীরা যে বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখেন বা যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন।
৬. পরামর্শের জন্য প্রেরণ (Referral for services) : ক্লায়েন্টকে অধিকতর সেবাদানের জন্য সমাজকর্মী তার চেয়ে অধিক দক্ষতাসম্পন্ন সমাজকর্মী বা বিশেষজ্ঞের কাছে প্রেরণ করবেন। সমাজকর্মী যদি বিশ্বাস করেন যে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য পেশাদার সমাজকর্মী অধিকতর সেবা প্রদান করতে পারবেন সেক্ষেত্রেও তিনি তার ক্লায়েন্টকে রেফার করবেন। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীকে তার ক্লায়েন্টের সম্মতি নিতে হবে। উল্লেখ্য সমাজকর্মী রিফারেলের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ফি নিতে পারবেন না ।
৭. যৌন সম্পর্ক (Sexual Relationship) : যেসব সমাজকর্মী সুপাভাইজার বা এডুকেটর হিসেবে কাজ করেন তারা তাদের অন্যান্য সুপাভাইজার, শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী অথবা অন্য কোনো সহকর্মীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন না। তারা তাদের সহকর্মীর সাথেও কোনোভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন না কেননা এটা তাদের মধ্যে কোনো না কোনো সময় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে ও পেশার ক্ষতিসাধন করতে পারে।
৮. যৌন নির্যাতন (Sexual Relationship) : সুপাভাইজার অন্যান্য সুপাভাইজার, শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী, অথবা সহকর্মীদের উপর কোনরূপ যৌন নিপীড়ন চালাবেন না। এক্ষেত্রে যৌন সুবিধাজনক অবস্থা, যৌন নিবেদন, যৌনকর্মের অনুরোধ প্রস্তাব এবং যে কোনো মৌখিক ও শারীরিক ইশারা কোনোকিছুর প্রতিই ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না।
৯. সহকর্মীর অবনতি ও দুর্বলতা (Impairment of colleagues) : একজন সমাজকর্মী তার সহকর্মীর দুর্বলতা
কোথায় তা তিনিই ভালো করে জানেন।সহকর্মীর ব্যক্তিগত সমস্যা,মনোসামাজিক আপদ, মাদক ব্যবহার, অথবা মানসিক জটিলতা সম্পর্কে তার সহকর্মীরাই ভালো জানেন।এসব বিষয় কাটিয়ে উঠতে একজন সহকর্মী অন্যজনকে সাহায্য করবে।
১০. সহকর্মীর অযোগ্যতা (Incompetence of Clients) : সহকর্মীর কোনো ক্ষেত্রে অযোগ্যতা থাকতে পারে।এই অযোগ্যতা দূর করে একজন দক্ষ সমাজকর্মী হিসেবে গড়ে তুলেতে অন্যান্য সহকর্মী যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে অদক্ষ সহকর্মীকে সাহায্য করবেন।
১১. অনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে প্রতিবেদন (Reporting Unethical Conduct) : সমাজকর্মীগণ তাদের সহকর্মীদের অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে কেউ অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হলে সমাজকর্মীগণ তাকে সে কাজ থেকে ফিরিয়ে আনবেন, তবে এটিকে প্রতিশোধ হিসেবে নিবেন না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজকর্মীদের পেশাগত অনুশীলনের ক্ষেত্রে অবশ্যই উপরিউক্ত নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলতে হয়। সমাজকর্মীগণ যদি এসব মূল্যবোধ মেনে চলতে ব্যর্থ হন তাহলে তারা পেশাগত চর্চাও করতে পারেন না। এগুলো মেনে চললে সেবার মান বৃদ্ধি পায় এবং সমাজকর্মী নিরপেক্ষতা বজায় রেখে পেশাগত সেবার কাজ চালিয়ে নিতে পারেন।