সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের নীতিগুলো বর্ণনা কর।

অথবা, সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের নীতিগুলো লিখ।
অথবা, সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের নীতিসমূহ উল্লেখ কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
প্রতিটি পেশার ন্যায় সমাজকর্মেরও কতকগুলো নীতি রয়েছে । সমাজকর্মীদের এ নীতিগুলো অনুসরণ করে কাজ করতে হয় । এ নীতিগুলো সমাজকর্ম অনুশীলনের Guideline বা Principle হিসাবে কাজ করে ।
সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের নীতি : সমাজকর্মের নৈতিক মানদণ্ডের নীতিগুলো হলো :
১. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার : মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য নির্মাতা। আর মানুষকে তার নিজের ভাগ্য নির্মাণের সুযোগ প্রদান বা অধিকার দান হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার। এটি সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত। সমাজকর্ম মানুষকে তার চাহিদা, পছন্দ, সামর্থ্য ও ক্ষমতানুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দানে সমস্যা সমাধানে তার নিজের ভূমিকা পালনে বিশ্বাসী ।
২. ব্যক্তির মর্যাদার স্বীকৃতি : এর মূল কথা হলো মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তার আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান । সমাজের মূল উপাদান হিসেবে সমাজের প্রত্যেকেই পৃথক মর্যাদা ও সত্তার অধিকারী । সমাজকর্ম ধর্ম, বর্ণ, পেশা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের বিশেষ মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি দানে বিশ্বাসী ।
৩. সকলের সমান সুযোগ : সকলের সমান সুযোগ প্রদান সমাজকর্মের একটি নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃতি । এ মূল্যবোধের ফলে সমাজকর্ম নারী পুরুষ, জাতি, বর্ণ, ছোট বড় সকলকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে এবং সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে বৈষম্যহীনতায় বিশ্বাস করে। ফলে সকলের কল্যাণ নিশ্চিত করা সহজ হয়।
৪. স্বনির্ভরতা অর্জন : সমাজকর্ম বিশ্বাস করে, প্রত্যেক মানুষের ভিতরে রয়েছে সুপ্ত সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ । সমাজকর্ম মানুষের যোগ্যতা ও সামর্থ্যানুযায়ী এমনভাবে সাহায্য করে যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতার সুযোগ পায় ।
৫. গণতান্ত্রিক অধিকার : সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ হিসেবে চিহ্নিত হলো গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার ও মনোভাব। এর মূল কথা হলো প্রত্যেক মানুষ অধিকার ও কর্তব্যে সমান এবং গুরুত্বের দিক থেকেও সমান । এ কারণে ব্যক্তি স্বার্থ সংরক্ষণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। এটি মানুষের অধিকার সংরক্ষণ ও সামাজিক সমস্যা প্রতিষ্ঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে । গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ প্রশস্ত করতেও সাহায্য করে ।
৬. শ্রমের মর্যাদা : ব্যক্তি জীবনে উন্নয়ন ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য শ্রমের মর্যাদার প্রভাব অপরিসীম । এ কারণে কোনো শ্রমকেই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয় । সমাজকর্ম শ্রমের যথাযথ মর্যাদাদানে বিশ্বাসী ।
৭. সম্পদের সদ্ব্যবহার : সম্পদের সদ্ব্যবহার সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও মূল্যবোধ । সম্পদের সঠিক ব্যবহার হলে সমাজ থেকে বিভিন্ন সমস্যা দূর হবে । সমাজকল্যাণ নিশ্চিত হবে।
৮. পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ : সমাজকর্মের পেশাগত সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করতে এ মূল্যবোধের প্রয়োজন হয়।কেননা সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন। আর এ জন্য সমাজকর্মী ও সাহায্যার্থীর মধ্যে এ মূল্যবোধের অভাব পুরো সাহায্য প্রক্রিয়ায় ব্যাহত হয় ।
৯. সামাজিক দায়িত্ব : সমাজকর্ম সামাজিক দায়িত্ব পালনের মূল্যবোধে বিশ্বাসী । সমাজের প্রত্যেক মানুষকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি, নিজের প্রতি ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে হয় ।
১০. ব্যক্তিস্বাধীনতা : স মাজকর্মের একটি মূলনীতি হলো ব্যক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা । ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী কাজ করে তবেই ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব। আর সমাজকর্ম ব্যক্তিত্ব বিকাশের লক্ষ্যেই ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে ।
১১. গোপনীয়তা : গোপনীয়তার নীতি হলো সমাজকর্মী ও সাহায্যার্থীর মধ্যকার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য চুক্তি।সাহায্যার্থী যেন নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে তথ্য প্রকাশ করতে পারে সমাজকর্মীকে সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই সমস্যার মূল কারণ উদ্ঘাটিত হবে এবং সমস্যার সঠিক সমাধান হবে।
১২. গ্রহণ নীতি : সমাজকর্মের একটি বিশেষ নীতি হলো গ্রহণের নীতি। এটা সামগ্রিক সমস্যার সমাধান বা সেবাসহায়তার কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয় । সমাজকর্ম সেবা সহায়তায় সমাজকর্মী ও সাহায্য প্রার্থীর পারস্পরিক গ্রহণ ও সুসম্পর্ক স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেবা সহায়তার কৌশল বিশারদ এবং পেশাদার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাজকর্মীকেই পারস্পরিক গ্রহণের মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পেশা হিসেবে সমাজকর্ম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ।কারণ এখানে সাহায্য প্রার্থীর মতামত, অংশগ্রহণ, ক্ষমতায়ন, ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ইত্যাদি নীতি ও কৌশল অনুসরণ করা হয় । যা সমাজকর্মকে অন্যান্য সকল পেশা থেকে স্বাতন্ত্র্য করে তোলে ।