শিল্পায়নে কৃষির ভূমিকা ও গুরুত্ব আলোচনা কর ।

প্রশ্নঃ শিল্পায়নে কৃষির ভূমিকা ও গুরুত্ব আলোচনা কর ।

উত্তরা ভূমিকা : দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষিখাতের এবং পল্লি অঞ্চলের ভূমিকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে মানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে । মূলত কৃষি উন্নয়নের সাথে শিল্পোন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত । টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে কৃষিক্ষেত্রে ও খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশকে সমৃদ্ধ করার কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে । নিম্নে বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে কৃষির ভূমিকা ও গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. খাদ্যের যোগান : কৃষিকে অনুন্নত রেখে বর্তমান খাদ্য ঘাটতি কোনভাবেই দূর করা যাবে না । প্রতি বছর খাদ্য ঘাটতির জন্য আমাদেরকে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হয় । অতএব কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে যদি খাদ্যাভাব দূর করা যায় , তাহলে কৃষিপণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সমস্ত বৈদেশিক মুদ্রাই শিল্পোন্নয়নের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে । ফলে শিল্পোন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে ।

২. কৃষি উপকরণ উৎপাদনকারী শিল্পের প্রসার : পাম্প মেশিন , থ্রেসার , পাওয়ার টিলার , হারভেস্টিং মেশিন , কীটনাশক ঔষধ , নলকূপের পাইপ ইত্যাদি উৎপাদনকারী শিল্পের প্রসার কৃষিখাতের উন্নতির উপর নির্ভরশীল । সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের শিল্প গড়ে উঠেছে । সুতরাং আমাদের কৃষিক্ষেত্রের ব্যাপক উন্নতি করা সম্ভব হলে এ ধরনের শিল্পকারখানা আরো বিস্তৃত আকারে গড়ে উঠবে ।

৩. মূলধন গঠন : কৃষি উন্নয়নের ফলে আমাদের কৃষকের আয় বাড়বে এবং তাতে দেশে মূলধন সঞ্চয় হবে । তাছাড়া কৃষি উন্নয়নের ফলে কৃষকদের কর প্রদান ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সরাসরি রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে । সরকারি রাজস্ব , মূলধন ও কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে । এতে শিল্পোন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে ।

৪. শিল্পের কাঁচামাল : আমাদের শিল্পকারখানায় কাঁচামাল যোগায় কৃষি । বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শিল্পসমূহ তথা পাট , বস্তু , চা , চিনি , কাগজ প্রভৃতি তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জন্য সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল । আমাদের শিল্পোন্নয়নের প্রধান স্তম্ভ হলো পাট শিল্প । কৃষিখাতে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদন করা যায় এবং সেগুলো স্বল্পমূল্যে যোগান দেয়া যায় , তাহলে শিল্পগুলো বিশ্ব বাজারে আপেক্ষিক সুবিধা উপভোগ করতে পারবে এবং দ্রুত শিল্পায়ন হবে ।

৫. শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা : কৃষির উন্নয়ন ঘটলে কৃষকদের মাথাপিছু আয় বাড়বে । ফলে গ্রামাঞ্চলে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে । সুতরাং শিল্পজাত পণ্যের বাজার বিস্তৃত করতে হলে কৃষি উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য ।

৬. উদ্বৃত্ত সৃষ্টি : শিল্প উন্নয়নের জন্য যে মূলধন প্রয়োজন তার জন্য অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করা প্রয়োজন । বাংলাদশে এ উদ্বৃত্ত কৃষিখাতেই সৃষ্টি করা সম্ভব । বস্তুত বাংলাদেশের কৃষি যে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করেছে তা যদি পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হয়ে যায় , তাহলে বাংলাদেশ শিল্পায়নে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে । বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানিতে এককভাবে কৃষিজাত প্রাথমিক পণ্যদ্রব্যের অবদান শতকরা প্রায় ৭ ভাগ । এছাড়া শিল্পজাত দ্রব্য বিশেষত পাট ও চামড়া রপ্তানিতে কৃষির অবদান অগ্রগণ্য । অতএব দেখা যাচ্ছে যে , উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করাতে এবং শিল্পের মূলধন দ্রব্য আমদানি করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে কৃষির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ ।

৭. শিল্পের যন্ত্রপাতি : শিল্পোন্নয়নের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য আমাদেরকে বিদেশের উপর বহুলাংশে নির্ভর করতে হয় । কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে আমরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি তার মাধ্যমেই আমাদেরকে শিল্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয় । সুতরাং বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়নের জন্য কৃষির উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য ।

৮. শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি : কৃষিজাত পণ্য শিল্পের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । বাংলাদেশের কৃষির উন্নতি হলে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি দূর করে বৈদেশিক মুদ্রা শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা যাবে । এতে করে দেশের শিল্পোন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে ।

৯. খাদ্যশস্যের মূল্য : খাদ্যশস্যের মূল্যের উপর শিল্প শ্রমিকের মজুরির হাত বহুলাংশে নির্ভরশীল । কম দামে খাদ্যশস্যের যোগান অব্যাহত রাখতে পারলে শিল্প শ্রমিকের মজুরি নিম্ন স্তরে রাখা যাবে । অন্যদিকে , খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে শ্রমিকেরা উচ্চ মজুরির জন্য পীড়াপীড়ি করবে এবং শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হবে , ফলে শিল্পোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে । সুতরাং কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্যশস্যের দাম কমাতে পারলে তা দেশের শিল্পোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে ।

১০. শিল্প শ্রমিকের খাদ্যের যোগান : শিল্পখাতে নিয়োজিত শিল্প শ্রমিকদের খাদ্য সংস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । বাংলাদেশের কৃষিখাত খাদ্যের যোগান দেয় । কৃষি অনুন্নত থাকলে শিল্প শ্রমিকদের জন্য খাদ্য আমদানি করতে হবে এবং তা হবে শিল্পোন্নয়নের একটি অন্তরায় । অতএব বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়নে কৃষির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ ।

১১. কাঁচামালের মূল্য হ্রাস : বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন হলে কৃষি থেকে উৎপাদিত কাঁচামালের মূল্য হ্রাস পাবে । কাঁচামালের দাম কমলে আমাদের শিল্পের উৎপাদন খরচ কম হবে এবং এর ফলে মুনাফা ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি শিল্পের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে , বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্প উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । শুধু কৃষি কিংবা শিল্পোন্নয়ন দ্বারা আমাদের জাতীয় আয়ের দ্রুত বৃদ্ধি সম্ভব নয় , তবে দেশের দীর্ঘকালীন উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে কৃষির তুলনায় শিল্পকেই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে । কারণ শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতিকে উন্নত স্তরে পৌছে নিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব । তাছাড়া ভূমির স্বল্পতা ও কৃষি প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের দেশে কৃষির তুলনায় শিল্পোন্নয়নের সম্ভাবনার দিগন্ত অনেক বেশি দূর প্রসারিত । শ্রমের সহজলভ্যতার কারণে শ্রম প্রগাঢ় শিল্প প্রসারে বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে । সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশে কৃষির তুলনায় শিল্পকেও প্রাধান্য দিতে হবে ।