কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিক গুরুত্ব আলোচনা কর ।

প্রশ্নঃ কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিক গুরুত্ব আলোচনা কর ।

উত্তর। ভূমিকাঃ সংকীর্ণ অর্থে কৃষি বলতে ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলানোকে বুঝায় । কিন্তু ব্যাপক অর্থনীতিতে ‘ কৃষি ‘ কথাটি ব্যাপক তাৎপর্য বহন করে । অর্থনীতির আলোচনায় মাটি চাষ করে ফসল উৎপাদন , ফলমূল উৎপাদন , শাকসবজি উৎপাদন ও পশুপালন প্রভৃতি সকল বিষয়ই কৃষির অন্তর্ভূক্ত । কৃষি অর্থনীতিবিদ আর . এল . কোহেন এর মতে , পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন শিল্প হলো কৃষি । আজও কৃষি পৃথিবীর বৃহত্তম শিল্প । কৃষি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের অর্থাৎ দুই – তৃতীয়াংশ লোকের জীবিকার প্রধান উৎস । কৃষির উন্নয়নের ফলশ্রুতিতেই অনেক দেশ শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হতে পেরেছে । একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা ব্যাপক । বাংলাদেশ প্রধানত কৃষিনির্ভর ।

কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিক গুরুত্ব: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ । কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড । এদেশের প্রায় শতকরা ৫০ জন মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল । বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদনের শতকরা প্রায় ২০ % ভাগ আসে কৃদ্ধি হতে । এজন্য অনেকে মনে করেন যে , শিল্প অপেক্ষা কৃষির উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত । তাঁদের মতে , উদ্বৃত্ত কৃষিজ্ঞাত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে বিদেশ হতে শিল্পজাত দ্রব্য আমদানি করা হয় । কৃষির সাথে সাথে শিল্পের উপরও গুরুত্বারোপ করা উচিত । কৃষিকে অবহেলা করে যেমন শিল্পোন্নয়ন সম্ভব নয় , কৃষির সাথে শিল্পকে অবজ্ঞা করে কৃষির উন্নতিও আশা করা যায় না । বস্তুত কৃষি ও শিল্প পরস্পর নির্ভরশীল । সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে হলে শিল্পের ভূমিকাকে কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না , বরং দেশের দীর্ঘকালীন উন্নয়নের স্বার্থে কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে কৃষির তুলনায় শিল্পকেই অধিক গুরুত্ব দিতে হবে । নিয়ে বাংলাদেশে কৃষি ও শিল্পের আপেক্ষিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো ।

প্রথমত , বাংলাদেশ শিল্পোন্নয়নের চেয়ে কৃষির অগ্রগতির হার অত্যন্ত কম হয় । কারণ কৃষি উন্নয়ন কৃষক ও কৃষি জমি এ দু’য়ের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল এবং এ দুটির উপর হলে দেশের সামাজিক পটভূমির ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করা প্রয়োজন । অতএব শিল্পের উন্নয়নের চেয়ে কৃষির উন্নয়ন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ।

দ্বিতীয়ত , বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র কৃষিপণ্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয় । বিদেশের বাজারে কৃষিপণ্যের দাম উঠানামা করে । ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । পক্ষান্তরে , আমরা যদি নানাপ্রকার শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে পারি , তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্যে আমাদেরকে এ ধরনের অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হবে না ।

তৃতীয়ত , কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এর কোন বিকল্প নেই । কৃষিকাজে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি প্রয়োগ করার ফলে জমির উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায় । কিন্তু শিল্পোন্নয়ন ছাড়া কৃষির আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি , রাসায়নিক সার প্রভৃতি উৎপাদন করা অসম্ভব ।

চতুর্থত , বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির কারণে কৃষির উপর যে চাপ পড়েছে তা রোধ করতে হলে এদেশে দ্রুত শিল্প উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য । দেশে দ্রুত শিল্পকারখানা স্থাপন করে এ বাড়তি জনসংখ্যাকে কৃষি থেকে সরিয়ে আনতে পারলে তা কৃষির জন্য মঙ্গলজনক হবে ।

পঞ্চমত , বাংলাদেশে কৃষির সাফল্য অনেকটা অনিশ্চিত । কারণ বন্যা , ঝড় , সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের কৃষি ব্যবস্থা অনেক সময় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে তেমন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা নেই । সুতরাং শিল্পকে বাদ দিয়ে শুধু কৃষির উপর নির্ভর করা বিপজ্জনক ।

ষষ্ঠত , বর্তমানে আমাদের দেশে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে । কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্তরের উপর কৃষির উৎপাদন বাড়ানো খুবই ব্যয়বহুল হবে । কারণ ঐ স্তরে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হলে বন্যা ও জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান , বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাকে চাষের অধীনে আনয়ন ইত্যাদির জন্য ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । এসব প্রকল্পের জন্য যে সুবিশাল ব্যয়ের প্রয়োজন হবে , তাতে ঐ পর্যায়ে কৃষির চেয়ে শিল্পের আপেক্ষিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে । ফলে কৃষির চেয়ে শিল্পে বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অধিকতর লাভজনক । সুতরাং কৃষিপ্রধান দেশ হলেও বাংলাদেশে শিল্পের গুরুত্বকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই ।

সপ্তমত , শিল্প বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃষিজাত দ্রব্য বাজারজাতকরণে সাহায্য করে । এর ফলে কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হয় । ফলে কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে ।

অষ্টমত , বাংলাদেশে কৃষির তুলনায় শিল্পের উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেক দূর প্রসারিত হয়েছে । কৃষিতে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি প্রযোজ্য । আধুনিক চাষাবাদের দ্বারা এ বিধির কার্যকারিতা স্বল্পকালের জন্য রোধ করা সম্ভব হলেও একে খণ্ডন করা যায় না । কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না ।

নবমত , বাংলাদেশে কৃষির উন্নয়ন সাধন করতে হলে আমাদের ছোট ছোট কৃষিজোতগুলোকে ভেঙে বৃহদায়তন খামারের পরিণত করতে হবে । এসব বৃহদায়তন খামারগুলোতে যান্ত্রিক চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন করা হলে কৃষিক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে । এ উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য দেশে ব্যাপক শিল্প সম্প্রসারণের প্রয়োজন আছে সুতরাং শিল্পের সাহায্য ছাড়া আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়ন অসম্ভব ।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে , কৃষি ও শিল্প পরস্পর নির্ভরশীল এবং উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ । কৃষির উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতেই অনেক দেশ শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রসর হয় । সেই সাথে কৃষির যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিতে শ্রম নিবিড় প্রযুক্তির পরিবর্তে পৃঞ্জি নিবিড় প্রযুক্তির ব্যবহার ত্বরান্বিত হবে এবং অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন বা কল্যান নিশ্চিত হবে।