অথবা, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য লিখ।
অথবা, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো কী কী ব্যাখ্যা কর।
অথবা, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।
অথবা, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : শিক্ষা হচ্ছে তৃতীয় চোখ। শিক্ষা হচ্ছে এক প্রকারের শক্তি, যা অন্ধকার দূর করে আলো নিয়ে আসে । শিক্ষা জগৎ ও প্রকৃতিকে আলোকিত করে। শিক্ষা শুধু অন্ধকারই দূর করে না। শিক্ষা একটি জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌছে দিতে পারে। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র শিক্ষাকে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা। বিভিন্ন মনীষী বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনায় বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. নব্য ডারউইন মতবাদের আলোকে : নব্য ডারউইন মতবাদের আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিকে বা জাতিকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করা। সমাজে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকাই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
২. নব্য লেমার্কপন্থিদের আলোকে : নব্য লেমার্কপন্থিদের আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বসবাসের পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে নেওয়া।
৩. বার্নার্ড শ এর মতে : বার্নার্ড শ এর মতে, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির উন্নতি বিধান । মানুষ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে উন্নতি লাভ করতে পারে একথাই তিনি বলেছেন ।
৪. যান্ত্রিক স্বভাববাদের আলোকে : যান্ত্রিক স্বভাববাদের আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জটিল থেকে জটিলতর বিষয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সুখ অর্জন করা।
৫. ম্যাগডুগালের মতে : ম্যাগডুগালের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানব প্রকৃতির উদ্যমকে ঊর্ধ্বমুখী, সুসংহত ও সুসংবদ্ধ করা। এর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির পূর্ণ বিকাশ সাধন।
৬. স্পেন্সারের মতে : স্পেন্সার শিক্ষার পাঁচটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যথা :
i. আত্মরক্ষা : শিক্ষা মানুষকে স্বাস্থ্য বিধির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং জীবনধারণের জন্য প্রস্তুত করে। এভাবে ব্যক্তির আত্মরক্ষায় সাহায্য করে।
ii. জীবিকা উপার্জন : মানুষের অর্থনৈতিক যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অর্জনে শিক্ষা যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়। যা ব্যক্তির জীবিকা অর্জনের সাথে সম্পর্কিত।
iii. সন্তান পালন : সন্তান কিভাবে লালন পালন করতে হবে মানুষ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সেটি জানতে পারে।
iv. সামাজিক ও রাজনৈতিক দক্ষতা : শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক দক্ষতা অর্জন করে।
v. অবসর বিনোদন : শিক্ষা মানুষের অবসর বিনোদনের সুষ্ঠুবোধ জাগ্রত করে। এভাবে শিক্ষা মানুষের সার্বিক জীবনের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৭. রুশোর মতে : রুশো শিক্ষার কতকগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যেমন-
ক. শিশুকে সক্রিয় করে গড়ে তোলা।
খ. শিশুর কর্ম ইন্দ্রিয়গুলো সক্ষম করে তোলা।
গ.শিশুর জ্ঞান ইন্দ্রিয়গুলো কার্যকরী করা।
ঘ. শিশুর মানসিক বিকাশ সাধন।
রুশোর মতে, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে ব্যক্তির পরিপূর্ণ স্বাভাবিক বিকাশের মাধ্যমে সুসামঞ্জস্য ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা।
৮. পেস্তালৎসীর মতে : পেস্তালৎসী তাঁর ‘সন্ন্যাসী জীবনের শেষ বেলা’ গ্রন্থে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিশুর অন্তর্নিহিত গুণাবলির সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশ সাধন।
৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কেবল ইন্দ্রিয়ের শিক্ষা নয় বা জ্ঞানের শিক্ষা নয় । তিনি বোধের শিক্ষার কথাও বলেছেন। প্রকৃতির পবিত্রতার সাথে একাত্ম হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
১০. প্লেটো ও এরিস্টটলের মতে : প্লেটো ও এরিস্টটলের মতে, শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অর্জন । আর জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে মানসিক উন্নতি সাধন করা যায়।
১১. জন লকের মতে : জন লকের মতে, “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানসিক শৃঙ্খলা বিধান। সেজন্য ধর্মীয় শিক্ষার চেয়ে ইহজাগতিক শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।”
১২. সমাজবিজ্ঞানী আরনল্ড গ্রিনের মতে : সমাজবিজ্ঞানী আরনল্ড গ্রিন শিক্ষার কতকগুলো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা
বলেছেন। যেমন-
i. সামাজিকীকরণ : পরিবারের পাশাপাশি ব্যক্তির সামাজিকীকরণে অবদান রাখা।
ii. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হস্তান্তর : শিক্ষা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
iii দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার : শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির কুসংস্কার দূরীভূত হয়। দৃষ্টিভঙ্গি, আস্থা, বিশ্বাস, আনুগত্য, প্রথার সমন্বয়ে দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কারসাধন করা যায়।
iv. পেশা প্ৰদান : শিক্ষা গ্রহণ ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের পেশা প্রদান করে।
v. প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের বিকাশ সাধন : শিক্ষা ব্যক্তিকে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব প্রদান করে। সমাজে টিকে থাকতে হলে ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। ব্যক্তি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিযোগী হয়ে ওঠে ।
১৩. জোহান হেনরিক পেস্টালজির মতে : পেস্টালজির মতে, শিক্ষার লক্ষ্য মানবিক গুণাবলির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ, যা পরিণামে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে সহায়ক হবে।
১৪. জন ডিউ এর মতে : জন ডিউ এর মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে সুষ্ঠু জীবনযাপন।
১৫. এমিল ডুর্খেইমের মতে : এমিল ডুর্খেইমের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হলো তরুণ প্রজন্মের সামাজিকীকরণ
১৬. জোয়াডের মতে : জোয়াড শিক্ষার তিনটি প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। যথা :
i. ছেলেমেয়েদের জীবিকা অর্জনের জন্য উপযুক্ত করে তোলা।
ii. গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যাতে নাগরিক হিসেবে তারা কাজ করতে পারে তার জন্য তাদের উপযুক্ত করে তোলা এবং
iii. তাদের মধ্যে যত সুপ্ত শক্তি এবং বৃত্তি আছে সেগুলো বিকশিত করে সৎ জীবনযাপন করার জন্য তাদের সমর্থ করে তোলা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিক্ষা ব্যক্তির গুণাবলির পূর্ণ বিকাশ ঘটায়। ফলে ব্যক্তি সামাজিক পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে পারে। শিক্ষা ব্যক্তিকে সামাজিকীকরণ ও পেশা গ্রহণের সহায়তা করে এবং প্রতিযোগী করে গড়ে তোলে। মানুষ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে সার্বিক জীবন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায়।