বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির প্রতিকার আলোচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির প্রতিকার বর্ণনা কর।
অথবা, কিভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা বিরতি রোধ করা যায়? আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতি রোধের উপায় বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি দেশের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে সে দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। সুতরাং যে কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সে দেশের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু কতকগুলো সুনির্দিষ্ট ও
সুশৃঙ্খল বছরের দ্বারা বিভক্ত, সেহেতু একজন শিক্ষার্থী এ বছরগুলোকে সাফল্যের সাথে অতিবাহিত করার মাধ্যমে সমাজে একটি দক্ষ মানব সম্পদরূপে পরিগণিত হয়। একেকটি বছর একজন শিক্ষার্থীর কাছে হিমালয়স্বরূপ। সকল বাধা, গ্লানি ও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। শিক্ষাবর্ষগুলো যাতে একজন শিক্ষার্থী সঠিকভাবে অতিক্রম করতে পারে সেজন্য সরকারপক্ষ থেকে সুষ্ঠু
নীতিনির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষা বিরতি বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে এটি বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার আশু প্রতিকার অনিবার্য।
বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির প্রতিকার : বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির হার আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এর প্রতিকার করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে শিক্ষা বিরতির প্রতিকার করা যায়। আমাদের দেশে শিক্ষা বিরতির প্রতিকারে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. দারিদ্র্য দূরীকরণ : বাংলাদেশে দারিদ্র্য সমস্যা দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষা বিরতির হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই শিক্ষা বিরতি রোধকল্পে দারিদ্র্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আর তা করতে পারলে বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব ।
২. পরিকল্পিত পরিবার গঠন : বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শিক্ষা বিরতির হার কমানো সম্ভব হবে। কারণ পরিকল্পিত পরিবার গঠনের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। একটি পরিবারে জনসংখ্যা যত কম হবে ঐ পরিবারে শিক্ষিতের হার তত বৃদ্ধি পাবে। এমনকি শিক্ষা বিরতির হারও হ্রাস পাবে।
৩. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জোরদার করা : প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি. করতে না পারে সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম জোরদার করে দুর্যোগ কবলিতদের স্বাভাবিক জীবনে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এ কাজ সঠিকভাবে করতে পারলে শিক্ষা বিরতির হার কমানো নিশ্চিত করা যাবে।
৪. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : গ্রাম বা পল্লি অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যেমন- কাঁচা বা আধাপাকা রাস্তাকে পিচঢালা পথে রূপান্তর, প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা, রাস্তা সম্প্রসারণ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা
যেতে পারে । আর এতে করে একদিকে যেমন গ্রামীণ মান বৃদ্ধি পাবে তেমনি শিক্ষা বিরতির হারও কমে যাবে।
৫. স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন : বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান অনুন্নত হওয়ায় এখানে শিক্ষা বিরতির হারও বেশি। শিক্ষার্থীদের সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের রোগশোকে সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ, সঠিক ঔষধদান, সঠিক পরামর্শসেবা প্রদান করতে হবে। আর এতে রোগমুক্ত সুস্থ স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে এবং শিক্ষা বিরতির হারও হ্রাস পাবে।
৬. শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ : একজন শিক্ষার্থী চায় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। শিক্ষার পরিবেশ যদি শিক্ষার্থীর অনুকূলে না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যার ফলে শিক্ষা বিরতির হার বৃদ্ধি পায়। এজন্য শিক্ষার্থীর শিক্ষার. জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ গঠন করতে পারলে শিক্ষা বিরতির হার হ্রাস পাবে।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা : রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রতিকূলে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশে রাজনীতির সুষ্ঠু পরিবেশ গঠন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা ঠিকমতো করতে পারলে শিক্ষা বিরতির হার কমে যাবে।
৮. অভিভাবকদের সচেতনতা সৃষ্টি : বাংলাদেশে অনেক অভিভাবক আছেন, যারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়া, চলাফেরা ও যত্ন-আত্মীর ক্ষেত্রে উদাসীন। এক্ষেত্রে ঐসব শিক্ষার্থীরা পিতামাতার অবর্তমানে যা ইচ্ছা তাই করে থাকে। এমনকি শিক্ষা বিরতিও দিয়ে থাকে। অভিভাবকদের সচেতন দৃষ্টি তাদের সন্তানদের উপর পড়লে বা তারা চাপ সৃষ্টি করলে শিক্ষা বিরতির হার অনেক কমে যাবে।
৯. পরীক্ষা সূচিতে সাময়িক পরিবর্তন : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় ফসল উত্তোলনের মৌসুমে বিভিন্ন সাময়িক পরীক্ষা এমনকি বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা বিরতি দিতে হয়।
বিদ্যালয়গুলোতে যদি ফসল উত্তোলনের মৌসুমে পরীক্ষার সময়সূচিতে সাময়িক পরিবর্তন আনে তাহলে বাংলাদেশে শিক্ষা
বিরতির হার অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
১০. সরকারের সদিচ্ছা : বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতি রোধকল্পে সরকারি সদিচ্ছার একান্ত প্রয়োজন। কারণ সরকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বিরতি রোধকল্পে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান, আর্থিক সহযোগিতা দান, বিভিন্ন রকম বৃত্তির ব্যবস্থা করলে অনেকেই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হবে। আর এতে করে বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির হার বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর পিছনে কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি কারণকে। এসব
সমস্যার মুখোমুখি হলেই একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা বিরতি দিয়ে থাকে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন, সুশীল সমাজ এবং আরও অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষার্থীদের উপর্যুক্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে আসে তাহলে বাংলাদেশে শিক্ষা বিরতির হার দ্রুত কমে যাবে বলে আশা করা যায় ।