অথবা,শাস্তির প্রতিশোধাত্মক মতবাদটির রূপ উল্লেখ কর।
অথবা, শাস্তির প্রতিশোধাত্মক মতবাদটির বর্ণনা দাও।
অথবা, শাস্তির প্রতিশোধাত্মক মতবাদটির ভূমিকা লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষের বিচ্যুত আচরণের চরম পর্যায়কে অপরাধ বলে। অপরাধের নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হচ্ছে শাস্তি। দেশে বিদ্যমান নানামুখী বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন অপরাধবিজ্ঞানী শাস্তি সম্পর্কে গবেষণা করে এর বিভিন্ন তত্ত্ব উৎঘাটন করেছেন। তাদের প্রদত্ত বিভিন্নরকম তত্ত্বের মধ্যে শাস্তির প্রতিরোধাত্মক, সংশোধাত্মক ও প্রতিশোধাত্মক মতবাদ অন্যতম।
প্রতিশোধাত্মক মতবাদ : ন্যায়বোধের উপর এ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। এ মত অনুসারে প্রতিশোধ হলো শাস্তির মূলকথা। নীতিবিজ্ঞানী লিলি বলেছেন, “এ মত অনুযায়ী শাস্তির উদ্দেশ্য হলো-অপরাধী যার উপর অপরাধ করেছে তার যে রকম কষ্ট হয়েছে অপরাধীকে ঠিক সেরকম কষ্ট পেতে হবে।” এ মতবাদ অনুসারে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার অর্থ তার দুষ্কর্মের জন্য তাকে দুঃখ দিয়ে নৈতিক নিয়মের সার্বভৌম মহিমাকে রক্ষা করা। এ মতবাদীরা মনে করেন, অপরাধীকে যদি শাস্তি দেওয়া না হয়, তবে নৈতিক নিয়মের কৃতিত্ব এবং মর্যাদা থাকে না। তাই তারা বলেন, অপরাধীকে শাস্তি দিলে তার প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়। কারণ, অপরাধী নৈতিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং শাস্তি তার ন্যায্য পাওনা বা প্রাপ্য। তাই তারা চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত এ নিয়মকে সমর্থন করেন। এ মতবাদ
অনুযায়ী শাস্তির উদ্দেশ্য হলো অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া। এ মতবাদ অবস্থা বিশেষে মৃত্যুদণ্ডকেও সমর্থন করে। এ মতবাদীরা বলেন, বাঁচবার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। যদি কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে হত্যা করে তাকে বাঁচবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তবে ন্যায়বিচার দাবি করে যে, হত্যাকারীরও বাঁচবার অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়া উচিত। এ প্রতিশোধাত্মক মতবাদের দু’টি রূপ আছে । যথা :
ক. কঠোর প্রতিশোধাত্মক : প্রতিশোধাত্মক মতবাদের কঠোর রূপ অনুসারে অপরাধের প্রকৃতি ও পরিমাণ অনুযায়ী শাস্তি বিধান করা প্রয়োজন। অপরাধ যদি কঠোর হয় তাহলে শাস্তি কঠোর হওয়া প্রয়োজন এবং অপরাধ যদি লঘু হয় তবে শাস্তি লঘু হওয়া প্রয়োজন। কোনো পারিপার্শ্বিক অবস্থায় অপরাধী অপরাধটি করেছে এ মতবাদ অনুসারে তা
বিচারের কোন প্রয়োজন নেই। কোন ব্যক্তি যদি কাউকে হত্যা করে, তবে হত্যাকারীকেও হত্যা করা উচিত। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা না করে কেবলমাত্র অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে অপরাধীকে শাস্তি বিধান করার কথা এ মতবাদীরা বলেন । নিম্নোক্ত ‘কারণে প্রতিশোধাত্মক মতবাদের কঠোর রূপটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ-
i.পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচার না করে যদি অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়, তবে অপরাধীর প্রতি অবিচার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে : এক ব্যক্তি আত্মরক্ষার জন্য তার শত্রুকে আঘাত করল ফলে লোকটি মারা গেল কিন্তু তাকে হত্যা করার কোনো ইচ্ছা আঘাতকারীর ছিল না। এ মতবাদ অনুসারে যদি উক্ত উভয় অপরাধীকে সমান শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে প্রথম অপরাধীর উপর অবিচার করা হয় তাতে কোনো
সন্দেহ নাই ।
ii.এ মতবাদটি প্রতিহিংসামূলক ভাবের উপর ভিত্তি করে আছে। প্রতিহিংসার ভাবকে নৈতিকতার দিক থেকে সমর্থন করা যায় না।
খ. লঘু প্রতিশোধাত্মক মতবাদ : প্রতিশোধাত্মক মতবাদের এ রূপের সমর্থকগণ বলেন, অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে, তৰে শাস্তি নির্ধারণের সময় অপরাধীর বয়স, চরিত্র এবং অপরাধ করার সময় তার শারীরিক মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে দেখতে হবে। যেমন এক ব্যক্তি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে একটি অপরাধ করেছে, একই অপরাধ আর এক ব্যক্তি স্থির মস্তিষ্কে করেছে। এ মতবাদ অনুসারে উ
ক্ত দুই অপরাধীকে সমান শাস্তি দেওয়া অনুচিত। উত্তেজনার বশে যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি, স্থির মস্তিষ্কে অপরাধকারীর চেয়ে কম হওয়া উচিত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, শাস্তির অন্যান্য মতবাদের তুলনায় এটি একটু ভিন্ন। কেননা ন্যায়বোধের উপর এ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। এতে বলা হয়, অপরাধীকে যদি শাস্তি প্রদান করা না হয় তবে নৈতিক নিয়মে কৃতিত্ব ও মর্যাদা থাকে না। তাই অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করলে তার প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় বলে এ মতবাদ গোষ্ঠীরা মনে করে।