রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্প বৈচিত্র্য পর্যালোচনা কর।

অথবা, রবীন্দ্রনাথের শিল্পী মনের বিস্তারিত বিবরণ দাও।
অথবা, রবীন্দ্রনাথের শিল্পী মনের বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তরা।। ভূমিকা :
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মানবতার জয়গান নিয়ে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত, উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, তিনি হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুন। তিনি বাঙালি জাতির গর্ব। বাংলা সাহিত্যের কর্ণধার। তাঁকে আকাশের সাথে তুলনা করা যায়। তিনি বাংলাদেশ দর্শনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পী মনের বর্ণনা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন শিল্পী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো।
১. রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতা : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গীতি কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর গীতি কবিতায় প্রেম, গ্রীতি, ভালোবাসা, আন বেদনার এক অপূর্ব দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন। তাঁর গীতি কবিতার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর আসল শিল্পী মনের রূপ। উনি তাঁর শিল্পী মনের এক নিখুঁত চিত্র লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাঁর গীতি কবিতায়।
২. বিশ্বের বিভিন্ন সংগীতের সমন্বয় : রবীন্দ্রনাথই হলেন একজন মানুষ যিনি বিশ্বের সকল স্থানের সংগীতের সাথে নিজের সংগীতের সমন্বয় করেছিলেন। তিনি শত শত সংগীত রচনা করে নিজের শিল্পী মনের পরিচয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন।
৩. চিত্রশিল্পী : রবীন্দ্রনাথ একজন আধুনিক প্রগতিশীল চিত্রশিল্পী। তিনি তাঁর হাতের মাধ্যমে অসংখ্য চিত্র অঙ্কন করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন চিত্রশিল্পে অত্যন্ত পারদর্শী। তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যসহ বহু বিষয়ে ছবি আঁকেন।
৪. প্রকৃতির সাথে চিত্রের সমন্বয় : রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন চিত্রে প্রকৃতির সাথে সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। প্রকৃতির সাথে মানুষের যেসব বিষয়ে মিল পরিলক্ষিত হয়, সে সম্পর্কে তিনি যে ছবি এঁকেছেন তাতে তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
৫. প্রকৃতির কথা : রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন কবিতায়, গল্পে যে প্রকৃতির কথা বলেছেন, তাতে তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন,
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুলে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।”
৬. বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনা : রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন কবিতায়, কাব্যে বিভিন্ন ঋতুর বর্ণনা করেছেন। বর্ষা ঋতুর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি তাঁর আষাঢ় কবিতায় বলেন,
“বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর
কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে।”
বর্ষা ঋতুর অপূর্ব রূপ, যে ছন্দ নিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় যেমন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনিভাবে গ্রীষ্ম, শীত, হেমন্ত, বসন্ত প্রভৃতি ঋতুর বৈশিষ্ট্য, গুণ তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন- এসবই তাঁর শিল্পী মনের পরিচয় বহন করে।
৭. প্রেমের বর্ণনা : রবীন্দ্রনাথ একজন মানবপ্রেমিক দার্শনিক। তিনি ভালোবাসতেন এ দেশের মাটি ও মানুষকে, ভালোবাসতেন এ দেশের প্রকৃতিকে। তিনি প্রকৃতিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-
নিখিলের সুখ নিখিলের দুঃখ
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি।
প্রকৃতির এ বর্ণনার মাঝেই ফুটে উঠে রবীন্দ্রনাথের আসল ব্যক্তিত্ব, তাঁর শিল্পী মনের পরিচয়।
৮. জীবন ক্ষণস্থায়ী : প্রতিটি জীবন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গের ন্যায় অলীক এবং ক্ষণস্থায়ী বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন। এ সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় জীবন ও জগতে কিভাবে দোলা দেয় তা তিনি তাঁর কবিতায় বর্ণনা করেছেন-
জগতের মহা-বেদব্যাস
গঠিলা নিখিল-উপন্যাস,
বিশৃঙ্খল, বিশ্বনীতি লয়ে
মহাকাব্য করিলা রচন।
উপসংহার : উপরের আলোচনা হতে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ একজন শিল্পী। তবে প্রচলিত অর্থে আমরা যাকে শিল্পী বলে অভিহিত করি, তিনি সেরকম শিল্পী নয়। তথাপি তিনি তাঁর কবিতা, গান, নাটকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশ্ব প্রকৃতির স্বরূপ, সামাজিক চেতনা প্রভৃতি বিষয়কে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাতে তাঁকে একজন প্রকৃত শিল্পী বলেই মনে হয়।