রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন কী?

অথবা, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
সমাজের উচ্চাসনে আসীন হয়েও যিনি অবহেলিত,উৎপীড়িত ও সর্বহারা মানুষের কথা ভেবেছেন, যাঁর জন্ম বাঙালি জাতির গর্ব, যাকে আকাশের সাথে তুলনা করা হয়, যার বিস্তৃতি বিশ্বজোড়া, তিনিই হলেন বাংলাদেশ দর্শনের অগ্রসৈনিক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিকদের মতো চিন্তা করেননি, অথচ তার চিন্তা যুক্তিহীন নয়। তাঁর মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম বোধশক্তি ছিল, যা তাঁর সকল কল্পনার মধ্যে মনস্বিতা সঞ্চার করেছে। অন্ধ আবেগের বদলে যুক্তিসিদ্ধ কল্পনাকে তিনি তাঁর সমগ্র সাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন।
প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শন : দর্শনের জনক থেলিস প্রাকৃতিক বস্তু পানিকে জগতের মূল উপাদান বলে ঘোষণা করার ফলে আমরা তাঁকে প্রকৃতিবাদী বলি। পাশ্চাত্য দর্শনের সবচেয়ে প্রাচীন ধারা হচ্ছে প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতিবাদীদের পুনরুত্থান ঘটে সতেরো এবং আঠারো শতকে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে। প্রকৃতিই হচ্ছে সমগ্র সত্তা। প্রকৃতিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো স্বভাবগত বিকাশকে সাহায্য করা। আর এ বিকাশ হবে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতি অনুযায়ী। এটিই প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনের মূল বক্তব্য। প্রকৃতিবাদী শিক্ষাদর্শনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হার্বার্ট স্পেন্সার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেন। যথা :
১. শিক্ষা অবশ্যই শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করবে।
২. শিক্ষা শিক্ষার্থীর স্বতঃপ্রণোদিত সক্রিয়তাকে ব্যবহার করবে।
৩. শিক্ষা হবে আনন্দময়।
৪. শিক্ষা হবে আরোহাত্মক।
৫. শিক্ষা হবে দেহ ও মনের জন্য এবং
৬. শাস্তিগুলোকে হতে হবে ভুল কাজের স্বাভাবিক পরিণতি সংবলিত।
প্রকৃতিবাদের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিবাদী। আবার ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে ও শিক্ষার প্রকৃতি নির্ধারণেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতিবাদী। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবনের শুরুতে বিকৃতির সমস্ত কৃত্রিম কারণ থেকে স্বভাবকে প্রকৃতিস্থ রাখা খুবই দরকার। এ অবস্থা শিশুদের জন্য সুখের অবস্থা। রবীন্দ্রনাথ শহরের শিক্ষাকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, কাজের ঘূর্ণির মধ্যে ঘাড়মুড় ভেঙে পড়ার আগে শিখবার সময়, বেড়ে উঠার সময় প্রকৃতির সহায়তা একান্তভাবে প্রয়োজন। অগ্নি, জলবায়ু, স্থলকে মনের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেখতে শেখাই প্রকৃত শেখা। শাস্তির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “দণ্ড স্বীকার করা নিজেরই কর্তব্য এবং না করলে সে গ্লানি মোচন হয় না- এ শিক্ষা ছেলেবেলা থেকেই হওয়া দরকার। শাস্তি পরের কাছ থেকে আসা অপরাধের প্রতিফলন। আর প্রায়শ্চিত্ত হলো নিজের অপরাধের সংশোধন করা। অন্যের কাছে নিজেকে দণ্ডনীয় করার হীনতা মনুষ্যচিত নয়।” শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “শিশুদের মানসিকতা বিকশিত করার জন্য তাদের প্রকৃতির মেঘ রৌদ্রের লীলাভূমি আকাশের নিচে খেলাধুলা করতে দেওয়া উচিত।” রবীন্দ্রনাথ শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার জন্য প্রকৃতিকেই নির্বাচন করেছেন। সংসারের সমস্ত প্রবৃত্তি সংঘাতের মধ্যে যথেচ্ছ মানুষ হলে গৃহস্থ হওয়ার মতো উপযুক্ত মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না, বিষয়ী হওয়া যায়, ব্যবসায়ী হওয়া যায়, কিন্তু মানুষ হওয়া কঠিন হয়। তিনি বলেছেন, প্রকৃত সুখ মনে, আয়োজনে নয়। এ সরল সত্যটুকু স্বীকার করে প্রকৃতিবাদীরূপে প্র তির মধ্য থেকে শিক্ষা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বভাবগত শিক্ষাধারার গন্তব্য সৃ ষ্টিধর্মী কাজের প্রতি, যা পরম সুন্দরের আদর্শে রূপায়িত হওয়ার প্রতীক্ষায়রত।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাক্ষেত্রে মতবাদ দিয়েছেন তা প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য অনিবার্য। তিনি জ্ঞান লাভের সকল প্রচেষ্টাকে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ আদর্শরূপে বর্ণনা করেছেন। তিনি শিক্ষাদর্শনে যে প্রকৃতিবাদী, ভাববাদী, প্রয়োগবাদী মতবাদ প্রকাশ করেছেন তা থেকে বলা যায়, তিনি আসলে সমন্বয়বাদী মতবাদ দিয়েছেন। তাঁর এ শিক্ষাদর্শন বর্তমান বিশ্বে উন্মোচন করেছে এক নতুন দিগন্তের। জ্ঞানের কোনো শাখাই এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ সত্যকে লাভ করতে পারেনি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজন এমন একটি আদর্শ, যা যুগের সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গি বহন করবে। জোরালো কণ্ঠে তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন ঐ প্রয়োজন মিটাতে পেরেছে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।