ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলির তুলনামূলক আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তুলনামূলক আলোচনা কর।
অথবা, মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার তুলনামূলক আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উভয়েই বর্তমান বিশ্বের দুটি সমৃদ্ধশালী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কর্ণধার। বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাদেরকে শ্রেষ্ঠতম শাসক হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্রিটেনের সমগ্র শাসনব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। তাই Prof. Laski বলেছেন, “The Prime Minister is the pivot of the whole system of governunent,” অপরপক্ষে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জীবনের মূর্ত প্রতীক এবং সমগ্র জনসমাজের প্রতিনিবি। W.Wilson বলেছেন, “He is the only national voice in affairs. His position takes the imagination of the country. He is the representative of no constituency but of the whole people.”

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তুলনা: নিম্নে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।

সাদৃশ্য: মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নিলিখিত সাদৃশ্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ

১. শাসক প্রথাল: মার্কিন রাষ্ট্রপতি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উভয়েই নিজ নিজ দেশের শাসন বিভাগের শীর্ষে অধিষ্ঠিত
এবং প্রধান শাসক হিসেবে পরিচিত। উভয়েরই শাসন বিভাগের উপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।

২. নির্বাচন প্রক্রিয়া: তত্ত্বগত বিচারে উভয়েই পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি একটি পার্লামেন্টের
সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের দ্বারা নির্বাচিত হন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উভয়ের নির্বাচনই প্রত্যক্ষ নির্বাচনে পরিণত হয়েছে।

৩. পদার্থার: মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উভয়েই নিজ নিজ দেশের শাসনব্যবস্থায় বিশিষ্ট পদমর্যাদার
অধিকারী। উভয়েই স্ব-স্ব শাসনব্যবস্থার মুখপাত্র। জাতীয় নেতা ও জনগণের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব।

৪. রাজনৈতিক দলের সমর্থন: উভয়েরই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া নির্ভর করে তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের উপর।

৫. ক্ষমতার পরিধি: উত্তর পদাধিকারীর ওমতার পরিধি সাধারণ ও জরুরি অবস্থা নির্বিশেষে মোটামুটি অভিন্ন। অর্থনৈতিক সংকট বা আগৎকালীন সময়ে উভয়েরই ক্ষমতার সীমা বিশেষভাবে সম্প্রসারিত হয়। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের ন্যায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ক্ষমতার পরিধি উলেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বৈসাদৃশ্য: মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উভয়ের ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও কার্যাবলির মধ্যে যেসব বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তা নিচে আলোচনা করা হলো

১. ক্ষমতার উৎস: মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা একটি লিখিত সংবিধানের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এদিক থেকে সুস্পষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রথাগত ঐতিহ্যের উপর নির্ভরশীল।

২. রাষ্ট্রপ্রবাস হিসেবে ভূমিকা: রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি যে ভূমিকা ও মর্যাদার অধিকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তা নেই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী শুধু শাসক প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান নন। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও শাসন বিভাগের কর্তা। সুতরাং, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে রকম প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদার অধিকার ভোগ করেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তা ভোগ করা সম্ভব নয়। Justice W.O.Douglas মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, “The office is respected more than any other in the land. It gives a position of leadership that is unique.

৩. প্রশাসনিক ক্ষমতার ভিত্তি: প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইনত ও কার্যত সকল শাসন ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় আইনত সকল শাসন ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজা বা রাণী, প্রধানমন্ত্রী নন।

৪. কেবিনেটের সাথে সম্পর্ক: মার্কিন কেবিনেটের সদস্যগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। তিনি এদের ইচ্ছামতো অপসারণ করতে পারেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে রাজা বা রাণীই মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। তাই খুশিমতো যে কোন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সবসময় সম্ভব নয়।

৫. ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন বা দাড়া হ্রাস করতে পারেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এ ক্ষমতা নেই। ব্রিটেনে এ ক্ষমতা ভোগ করেন রাজা বা রাণী।

৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে কোন বিষয়ে একক ও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে
পারেন। অন্যদিকে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভাকে বাদ দিয়ে একক ক্ষমতায় কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না।

৭. প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষমতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি স্থল, নৌ ও বিমান এ তিন বাহিনীর প্রধানদের নিযুক্ত করেন এবং অপসারণও করতে পারেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাজা বা রাণী, প্রধানমন্ত্রী নন।

৮. যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। তবে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা কংগ্রেসের অনুমোদন সাপেক্ষ। কিন্তু যুদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কিত মার্কিন রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে ক্ষেত্রবিশেষ কংগ্রেস অনুমোদন দিতে বাধ্য। অপরদিকে, ইংল্যান্ডে কেবিনেটের পরামর্শক্রমেই রাজা বা রাণী যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

৯. সামাজিক মর্যাদা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মার্কিন সমাজের নেতা হিসেবে এক মর্যাদা মণ্ডিত আসনের অধিকারী। তাঁর সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের ঈর্ষার বস্তু। ইংল্যান্ডে রাজা বা রাণীর এ মর্যাদা আছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেই।

১০. মেয়াদকাল: মার্কিন রাষ্ট্রপতি একটি নির্বাচনী সংস্থা কর্তৃক সর্বাধিক ভোটের ভিত্তিতে ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। অন্যদিকে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ৫ বছর। তিনি সংবিধান অনুযায়ী রাজা বা রাণী কর্তৃক ৫ বছরের জন্য নিয়োগ লাভ করেন।

১১. নিয়োগ সংক্রান্ত ‘ক্ষমতা: মার্কিন রাষ্ট্রপতির ব্যাপক নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার এ ক্ষমতা অবাধ বা অসীম নয়। রাষ্ট্রপতির সিনেটের অনুমোদন ছাড়া উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ সিনেট মেনে নিতে বাধ্য নয়। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ সংক্রান্ত সুপারিশ মেনে নিতে বাধ্য।

১২. আইন বিষয়ক ক্ষমতা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মত্যে আইন বিষয়ক ক্ষমতার অধিকারী নন। ব্রিটেনে আইন প্রণয়নের মুখ্য উদ্যোক্তা হলেন প্রধানমন্ত্রী। কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি সহজেই পার্লামেন্টকে দিয়ে নিজের এবং কেবিনেটের পছন্দমতো আইন পাস করিয়ে নিতে পারেন। সুতরাং, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেবল দেশের শাসক প্রধানই নন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।

Prof. Finer তাই যথার্থ বলেছেন, “The Prime Minister is mighter than the American President if he can carry his cabinet with him and then convince parliament.” বিস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা ও ব্লাধান্য নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে Prof. Laski এর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলা যায় যে, মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রিটি প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা অধিক। কিন্তু আধুনিক সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশের মতে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতা ও পদমর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে সবকিছু নির্ভর করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদাধিকারীদের ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, কার্যকুশলতা প্রভৃতি গুণগত যোগ্যতার উপর।