বৈষ্ণববাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এ প্রসঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের দর্শন আলোচনা কর।

অথবা, বৈষ্ণববাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রারম্ভিকতা আলোচনা কর। এ প্রসঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের দর্শন আলোচনা কর।
অথবা, বৈষ্ণববাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এ প্রসঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের দার্শনিক চিন্তাধারা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা ; বৈষ্ণব ধর্মমতের সার বা তত্ত্বকথা নিয়েই গড়ে উঠেছে বৈষ্ণববাদ বা বৈষ্ণব দর্শন। বিষ্ণুর উপাসকরাই বৈষ্ণব। এ মতে ঈশ্বরকে বিষ্ণু বা নারায়ণ, হরি বা কৃষ্ণ বলা হয়। তাঁর নামই একমাত্র উপাস্য। বৈষ্ণব সমাজ বিষ্ণুর নাম সংকীর্তন ও নাম জপকে আধ্যাত্য সাধনার প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই বৈষ্ণব মতে, দর্শন থেকে
ধর্মের প্রাধান্য বেশি। মধ্যযুগীয় বাংলার এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিতে বৈষ্ণববাদ উদ্ভব ও বিকাশ
লাভ করে।
বৈষ্ণববাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি : মধ্যযুগের বাঙালি হিন্দু সমাজের এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে বৈষ্ণববাদ নব আলো নব আশার বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়। বাংলায় বৈষ্ণববাদের এ আবির্ভাবের প্রেক্ষাপটে অতি প্রাচীনকালের ভারতীয় হিন্দু সমাজের ধারাবাহিক পরিবর্তন, বিবর্তনের ধারায় সূচিত। খ্রিস্টের জন্মের দু’শ বছর পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে বিরাট সামাজিক পরিবর্তন সংগঠিত হয়। এ সময় সনাতনী হিন্দুধর্মের বৈদিক ব্রাহ্ম সমাজ সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণিকে কখনোই মানুষ বলে মনে করতেন না। সমাজের নিচু তলার মানুষকে ব্রাহ্মণরা কখনো সামাজিক স্বীকৃতি দেয়নি।
এমনকি বৈদিক দেবতায়ও তাদের কোনো অধিকার ছিল না। সকল প্রকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার একচেটিয়াভাবে
ব্রাহ্মণদের দখলে। এ সময়ে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি তাদের মতো করে অবৈদিক দেবতার পূজা করতে থাকে। তাঁদের মধ্যে বাসুদেব কৃষ্ণ উল্লেখযোগ্য। এ অবৈদিক দেবতারা সমাজে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে যুগ পরিবর্তন ও আক্রমণকারী বিদেশি জাতির আবির্ভাব ও নতুন নতুন শিল্প কারুকর্মের প্রসারের ফলে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির আর্থিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে তাদের দেবতারাও অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। ফলে শূদ্রদের উপর পূর্বতন সমাজব্যবস্থায় যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিল সংকট উত্তরণের জন্য তার কিছু কিছু তুলে নেয়া জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কাজেই ব্রাহ্মণদের মধ্যে যারা আধুনিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন ছিলেন তারা অবৈদিক জনপ্রিয় আচারগুলোর সাহায্য নিলেন এবং অবৈদিক দেবতা বাসুদেব কৃষ্ণকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতে তুলে তাদের পতন ঠেকালেন। এভাবে প্রাচীনকালে বৈষ্ণবধর্ম হিন্দুধর্মকে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। কিন্তু প্রাচীনকালে অবৈদিক দেবতাদের স্বীকৃতি দিয়ে শূদ্রদের আচরণিক প্রথাকে মেনে নিলেও এ ধারা বেশিদিন অক্ষুণ্ণ থাকেনি। সেনযুগে আবার প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং সমাজে নানা ধরনের বিভাজন মানুষে মানুষে বিভেদ রেখা এঁকে দেয়। সেই সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়াবাড়ির কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম আপনা থেকেই ভেতরে ভেতরে দুর্বল
হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের ফলে সমাজের নিচু তলার মানুষ উদারপন্থি ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয়
নিতে থাকে দলে দলে । হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম আবার অস্তিত্ব সংকটে পতিত হয়। এরূপ রাজনৈতিক ও সামাজিক বাং প্রেক্ষাপটে নদীয়ায় শ্রীচৈতন্যদেবের আগমন ঘটে। শ্রীচৈতন্য এ সংকটকালে আবির্ভূত হয়ে এক নতুন ধারার আন্দোলন শুরু করেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে রক্ষা করার জন্য। চৈতন্যের এ ভাবান্দোলনে আবিষ্ট হয়ে পড়ে বাংলার সর্বস্তরের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ । ফলে হিন্দুধর্ম রক্ষা পায় অস্তিত্ব সংকট থেকে এবং প্রতিষ্ঠা পায় বৈষ্ণব ধর্মমত।
শ্রীচৈতন্যের দর্শন : মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত দর্শন গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর দর্শনের অপর নাম প্রেম দর্শন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ প্রেমভক্তিবাদে যে নব প্রাণের সঞ্চার করেন তাই প্রেম বা ভক্তিধর্মরূপে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে শ্রীচৈতন্যদেবের হাতে এবং পরিচয় লাভ করে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন নামে। এ দর্শন মতে,
শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান, তিনি পরমতত্ত্ব। মহাভারত, বায়ু, পুরাণ, বরাহ পুরাণ প্রভৃতি পৌরাণিক গ্রন্থে কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা নারায়ণের অংশ অবতার হিসেবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। কিন্তু চৈতন্য দর্শনে শ্রীকৃষ্ণই চৈতন্যরূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনো হয়। কৃষ্ণই একমাত্র পরম পুরুষ, অন্যসব দেবতা তাঁর কলা অংশ। কৃষ্ণই অবতারী, অন্যান্য সব অবতার তাঁর থেকে
উদ্ভূত। কৃষ্ণই পরম ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি মায়াশক্তিরূপে বিশ্বকে আচ্ছাদন করে রাখে। কৃষ্ণ যে শক্তি বলে বহুরূপে প্রতিভাত হন তার নাম বিলাস শক্তি। নারায়ণ কৃষ্ণের এ বিলাসরূপ, চৈতন্য দর্শন মতে, কৃষ্ণের বিলাস শক্তি দু’প্রকার।যথা : প্রভাববিলাস ও বৈভববিলাস। প্রভাববিলাসে গোপীদের সঙ্গে রামলীলাকালে কৃষ্ণ বহু কৃষ্ণে পরিণত হন। আর বৈভব বিলাসে তিনি বাসুদেব (বুদ্ধি), সংকর্ষণ (চেতনা), প্রদ্যুম্ন (প্রেম) ও অনিরুদ্ধ (লীলা) এ চতুর্ব্যহরূপ পরিগ্রহ করেন। তন্মধ্যে
কৃষ্ণের প্রধান শক্তি প্রেম। সর্বগুণবর্তী শ্রীমতি রাধা এ মহান প্রেমভাবের মূর্ত প্রতীক বা তাঁর (কৃষ্ণের) হ্লাদিনী শক্তি। চৈতন্য মতে, কৃষ্ণই একমাত্র অদ্বয় জ্ঞানবেদ্য তত্ত্ব। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর বর্ণনায় অদ্বয় জ্ঞানতত্ত্ব স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপশক্তি সমন্বিত তত্ত্ব । এই অদ্বয়তত্ত্বই স্বরূপ শক্তির দ্বারা অনন্ত বৈকুণ্ঠ বিস্তার করে তাতে স্বীয় সরূপাংশে
ষড়ৈশ্বর্যশালী নারায়ণরূপে এবং পরমাত্মা ও অবতারাদি স্বাংশস্বরূপে বিলাস করেন। কিন্তু বৈকুণ্ঠ শ্রেষ্ঠ লোক বলে সবার কাছে পরিচিত। বিষ্ণু পুরাণে এ ‘লোক’ এর অধীশ্বর হলেন ষড়েশ্বর্যপূর্ণ, শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী, চতুর্ভুজ নারায়ণ। এতে নারায়ণই হলেন শ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু চৈতন্য নারায়ণ অপেক্ষা শ্রীকৃষ্ণকেই উচ্চ আসনে স্থান দিয়েছেন। তাই এ মতে শ্রীকৃষ্ণই পরমতত্ত্ব, তাঁর মধ্যেই ভগবত্তার পূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের ‘দুই রূপ। একটি মুখ্য প্রকাশ অপরটি বিলাস। একই স্বয়ংরূপ যখন যুগপৎ অনেক স্থানে আবির্ভূত হন এবং ঐ প্রকটিত মূর্তি যদি সব গুণাবলির দ্বারা সর্বপ্রকারেই মূলরূপে সমান হয় তবে ঐ মূর্তি মূলরূপে মুখ্য প্রকাশ মূর্তি বলে পরিগণিত হয়। আর যিনি প্রায় মূলরূপে তুল্য শক্তিধর কিন্তু আকৃতিতে, বর্ণে ও নামে ভেদ, তাকে বিলাস মূর্তি বলে । শ্রীচৈতন্য মতে, নারায়ণই শ্রীকৃষ্ণের বিলাসমূর্তি, চৈতন্য শ্রীকৃষ্ণের জন্য নতুন ধাম সৃষ্টি করেছেন। তাঁর
নিকট বৈকুণ্ঠ বা নারায়ণের উপর শ্রীকৃষ্ণের স্থান নির্ধারিত। আর তাই শ্রীকৃষ্ণের নাম জপকীর্তন ও প্রেমভক্তির উপরই শ্রীচৈতন্যের দর্শনের মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। সংক্ষেপে এই হলো শ্রীচৈতন্যের দর্শনের মূলকথা।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, মধ্যযুগের বর্ণবিভক্ত হিন্দুসমাজের এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিতে বৈষ্ণববাদের উন্মেষ। বৈষ্ণববাদ বাংলা হিন্দু সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির নবপ্রাণের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। আর মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যের ধর্ম ও দর্শন চিন্তাই ছিল এই বাণীর মূল প্রবক্তা।