বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য নিভরশীলতা হ্রসের উপায়সমূহ বর্ণনা করা।
অথবা, বাংলাদেশে কীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারে? উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাধীনতা লাভ করলেও দীর্ঘকাল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত করুণ প্রকৃতির হয়েছে। স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ অনেকাংশে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্য হতে আমরা বাংলাদেশিরা এখনো আমাদেরকে যুক্ত করতে পারেনি। তাই দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস করতে হবে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাসের উপায় : বাংলাদেশ অতিমাত্রায় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতা হ্রাস করা অতি জরুরি, তাই এ নির্ভরশীলতা হাসের উপায়সমুহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
১. দেশীয় পুঁজি গঠনে উৎসাহ প্রদান : বৈদেশিক সাহায্য বা নির্ভরশীলতা হাস করতে হলে দেশের অভ্যন্তরে পুঁজি সংগঠন বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করে অধিকতর পুঁজি সংগঠন করা যেতে পারে। এজন্য দেশের জনসাধারণকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।
২.সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশে সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে পারলেও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস সম্ভব। সরকারি খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কর। রাজস্ব বাড়ানো যায়। বাংলাদেশের করের সিংহভাগ আসে পরোক্ষ কর থেকে। অতএব আয়করের মাধ্যমে কর। রাজস্ব বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। অন্যদিকে, সরকারের ব্যয় হ্রাস করাও সম্ভব। এতে করে সরকারের উদ্বৃত্ত বাড়বে এবং সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
৩. বেসরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধি : বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালে সঞ্চয় ছিল 3.০. এর ২৩.৮৯। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি। অতএব বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত রাজব ও মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে বেসরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। ৪. বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ : বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বেদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারলে বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে। অতএব বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিস্থিতি, সব প্রকার অবকাঠামোগত সুবিধা, মুনাফা, বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভয় থেকে মুক্তি ইত্যাদি নিশ্চিত করণের মাধ্যমে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে।
৫. বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি : বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্যের নির্ভরশীলতা হাস করার জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য রাজব ও মুদ্রাম্কীতির মাধ্যমে অবাধ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থা ও আর্থিক বাজারের সংষ্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগ সুবিধা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
৬. সাহায্য নিবিড় বিনিয়োগ ত্রাস : বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীলতা হ্রাস করার লক্ষ্যে সাহায্য নিবিড় বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি পরিহার করতে হবে। তার পরিবর্তে যে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি দেশীয় উপকরণ ও বিশেষজ্ঞ ব্যবহার করে সেগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. উৎপাদন ক্ষমতার পুনর্বযবহার : বাংলাদেশে অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার হয় না। বাজারে মুল্য অনুযায়ী উৎপাদন দক্ষ নয়, এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় না করে আমাদের বতমান বন্ধ শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রাখার ব্যবসা করতে হবে।
৮. উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা : বাংলাদেশে পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এমন প্রকল্পগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে যেগুলোর ইনপুট উৎপাদনকারী কারখানার অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা অর্থনীতিতে বর্তমান থাকে। এমন কোনো নতুন প্রকল্প স্থাপন করা যাবে না যার সকল ইনপুট আমদানি করতে হবে।
৯.আত্মনির্ভরশীল সীমিত প্রবৃদ্ধির কৌশল : একটি উন্নয়ন মডেল তৈরি করে দেখিয়েছে যে, আত্মনির্ভরশীলতা সহজে খাড়ানো যায়। যদিও তাতে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমবে। আমরা যদি বৈদেশিক সাহায্য কম ব্যবহার করি, তবে ৪.1. 9.5 মডেল অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির হার ৭.০৫-এ নেমে আসবে। কিন্তু আমরা যদি অধিক আত্মনির্ভরশীল হই তবে দেশের কলকারখানায় উৎপাদন ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় ব্যবহৃত হবে। ফলে উন্নয়নের ভিত্তি মজবুত হবে ।
১০. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা অর্জন : বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্বাস, করতে হলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক সাহায্যের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খাদ্য সাহায্য হিসেবে আসে। এমতাবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে ষয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারলে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হাস পাবে।
১১. পর্যাপ্ত খাদ্যের নমুত : প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের একটি অন্যতম সমস্যা। বাংলাদেশে প্রায়ই প্রাকাতক ..দুর্ধোগ হানা দেয় বিধায় আমাদের খাদ্যের মজুত রাখা প্রয়োজন। দেশের সবর উপযুক্ত গুদামে খাদ্য স্টক রাখা অত্যাবশ্যক|
১২. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন : বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্বনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হলে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে। সুতরাং দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সবিশেষ যত্ববান হওয়া উচিত
১৩. রপ্তানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ : দেশে অধিকসংখ্যক রপ্তানিমুখী শিল্প স্থাপন ও কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি অনেকাংশে দূর হবে এবং বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।
১৪. আপদানি বিকল্প : বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হলে আমাদের দেশে বিভিন্ন আমদানি শিল্প স্থাপন করতে হবে। বর্তমানে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করা হয়, তার ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এমতাবস্থার দেশে আমদানি বিকল্প ও আমদানি পরিপূরক শিল্প স্থাপন করা হলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর টাগবোন পাবে এবং বৈদেশিক সাহায্যর ওপর নির্ভরশীলভা কমে আসবে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি সাহায্য নির্ভরশীল অর্থনীতি এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তবে বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি গুরুত্ব বহন করলেও প্রত্যেক দেশকে ব্বাবলম্বী হওয়া উচিত, কারণ শক্তিশালী রাষ্ট্রসমুহ সর্বদা তাদের খ্বার্থে দুর্বল রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে উদ্যত হয়। আই বলা যায়, বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের মাধ্যমে যে অতিমাত্রায় পরনির্ভরশীলতার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে তাহ্রাস করা জরুরি।