বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব আলোচনা কর।

বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ভূমি সংস্কার বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, ভূমি সংস্কার কাকে বলে? বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তুমি সংস্কারের গুরুত্ব
ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : সাধারণ অর্থে ভূমি সংস্কার বলতে এমন এক কর্মসূচিকে বুঝায় ঘা ভূমি মালিকানা ও ভূমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক আমুল পরিবর্তন সুচিত করে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করাই হলো ভূমি সংস্কারের মুল লক্ষ্য। তবে ভূমি্বত্ব ব্যবস্থার দোষ-ক্রটি দুর করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনকানুন ও বিধি বিধানের সংস্কার সাধন করে ভূমিষত্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়ন করাকে ভূমি সংস্কার বলা হয় : ভূমি সংস্কার দ্বি-বিধ হতে পারে। যেমন-
১. বন্টনধর্মী ভূমি সংস্কার এবং
২. যৌথধর্মী ভূমি সংস্কার ।
১. ভূমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমালঙঘন করার পর যে উদ্বৃত্ত জমি পাওয়া যায় তা ক্ষুদ্র কৃষ্ক ও ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে বন্টন করে দেয়াকে বন্টনধর্মী ভূমি সংস্কার বলে।
২. ভূমির ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে আনয়ন করাকে যৌথধর্মী ভূমি সংষ্কার বলে । ভূমি মালিকানার হস্তান্তর না করেও ভূমিষত্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যায়। আর এই পরিবর্তনই হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সংক্কার। ভূমি মালিকানার পুনর্বিন্যাস, খণ্ডিত ভূমি একব্রীকরণ, মালিক প্রজা সম্পর্কের উন্নয়ন এবং কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমুহের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়সমূহ ভূমি সংস্কারের অপরিহার্য জঙ্গ। মোটকথা, ভূমি সংফ্কারের অর্থ হচ্ছে-ভূমি মালিকানা হস্তান্তর ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংক্কার।
অর্থনীতিবিদ বলেন, “ভূমি সংস্কার হচ্ছে ক্ষুদ্র ফার্ম ও কৃষি শ্রমিকদের কল্যাণার্থে ভূমি মালিকানার পূর্ণ বন্টন।” জাতিসংঘ প্রদত্ত ভূমি সংস্কারের রিপোর্ট অনুযায়ী বলা যায়, “কোনো অর্থনীতির গ্রামীণ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন সাধন করে যদি তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনা যায় তবে তাকে ভূমি সংস্কার বলা যেতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, ভূমি সংফ্কার বলতে দেশে প্রচলিত ভূমিষত্ব ব্যবস্থার ক্রটিসমুহ দুর করার লক্ষে জমির মালিকানা ও ব্যবহার সম্পর্কিত আইন কানুনের সংস্কার বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা: সাধনকে বুঝায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কৃষির উন্নতিই বাংলাদেশের সত্যিকার জাতীয় উন্নতি। আর কৃষির উন্নতি করতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থার যথাযথ সংষ্কার। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৬০% কৃষক এবং কৃষি তাদের প্রধান অবলম্বন। কাজেই বাংলাদেশের এ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তথা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন আনয়নের জন্য ভূমি সংষ্কারের গুরুত্ব অপরিসীম ।
২. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন: একথা সর্বজন ব্বীকৃত যে, অর্থনৈতিক ব্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। আর এ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে ভূমি সংক্কার করা একান্ত প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কারের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। তা না হলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না এবং দেশ বিশ্বের দরবারে সম্মান বা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।
৩. সমাজতন্ত্রে উত্তরণ : বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রকে সুষম রাষ্ট্র পরিচালনার একটি অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সমাজতন্ত্র উত্তরণের জন্য সম্পদের বন্টন অপরিহার্ধ, যা অনেকাংশে ভূমি সংস্কারের উপর নির্ভরশীল।
৪. খাদ্য উৎপাদন বুদ্ধি: ভূমি সংস্কারের মাধ্যমেই আমাদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। এদেশের শতকরা ৭৮ ভাগ জমিতে ধান চাষ করা হয়, কিন্তু একর প্রতি ফলনের ক্ষেত্রে জাপান যা উৎপাদন করছে বাংলাদেশ উৎপাদন করে তার মাও শতকরা ২০ ভাগ। অথচ বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ধান চাষের জন্য আরো বেশি উপযোগী। অধ্যাপক গুস্টার প্যাপানেক এ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “জাপান প্রতি একরে যা উৎপন্ন করে তার অর্ধেক উৎপাদন করতে পারলেই খাদ্য আমদানিকারী বাংলাদেশ অন্যতম খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে রূপান্তরিত হতে পারে।” তবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
৫. জাতীয় আয় বুদ্ধি : কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের এক বিরাট অংশ আসে কৃষি থেকে। কাজেই কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির জন্য তথা জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়ন করা একান্ত আবশ্যক। কেবল সুষ্ঠু ভূমি সংস্কারের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
৬. ভূমিহীনদের ভাগ্য উন্নয়ন: বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। এখানে ভূমিহীন কৃষক, বর্গাদার ও কৃষি মজুরদের মধ্যে ভূমি বন্টন ও বিতরণ করে তাদের ভাগ্যোন্নয়ন করা সম্ভব। একমাত্র সুষ্ঠু ভূমি সংস্কারের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব।
৭. ত্রুটিপূর্ণ ভূমি ব্যবস্থার সংশোধন : বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্রুটিপূর্ণ ভূমি ব্যবস্থার কাঠামোকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার জন্য ভূমি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। এখানকার কৃষিক্ষেত্রে সনাতন প্রক্রিয়ার প্রচলন, সেচ ব্যবস্থার সীমিত প্রবর্তন, কৃষিজ দ্রব্যের ন্যাধ্য মুল্যের অনুপস্থিতি, উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঝুকি গ্রহণে অনীহা, ভূমির আধুনিক উপকরণের সীমিত প্রয়োগ ইত্যাদি সবকিছুই ভূমি ব্যবস্থার কাঠামোর সঙ্গে সম্পুক্ত।
৮. আধুনিক পদ্ধাতিতে চাষাবাদের জন্য : উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত আমাদের কৃষিব্যবস্থার মালিকানায় রয়েছে যেমন- ক্রুটি তেমনি আমাদের জমির প্রকৃতিতেও রয়েছে খণ্তিকরণের সমস্যা। জমির ক্ষুদ্র ও খণ্ডিত অবস্থানহেতু আধুনিক পদ্ধাতিতে চাষাবাদ অসম্ভব। ফলে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চাষাবাদের ব্যবস্থা থেকে কৃষিকে মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
৯. রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমাণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ : বাংলাদেশে সুষম রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকন্পে তথা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষে সরকারি নীতি নির্ধারণ ও নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন বাংলাদেশে নতুনভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস সাধন । এক্ষেত্রে ভূমি মালিকানা ও ভূমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের গুরুত্ব অনহীকার্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব অস্বীকার। ভূমি সংস্কার ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। কেননা, এসব দেশে সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তাই ভূমির সুষম বন্টন ও দেশের উন্নয়নের জন্য ভূমি সংষ্লার করা একান্ত প্রয়োজন ।